বাড়িতে আসলে পার্টটাইম দোকানদারি করতে হয়। দোকান বলতে গ্রোসারি শপ। গ্রামের বাজার। একটা দোকানে বসেই পুরো দেশের জীবন যেন ভাসতে থাকে চোখের সামনে। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, অতি নিম্নবিত্ত… সব শ্রেণীর মানুষের জীবন, জীবিকা, জীবনধারা পরিষ্কার টের পাওয়া যায় একটা চেয়ারে বসে।
আমাদের দোকানে ৫৫-৬০ বছরের এক বৃদ্ধ বাজার করতে আসেন। বৃদ্ধ মানুষটি খানিকটা বুদ্ধি প্রতিবদ্ধি। কোদাল দিয়ে ঘাস তোলা এবং জমি নিড়ানি ছাড়া জীবনে আর কোনো কাজ শিখেননি। রাত কানা রোগ আছে। চিন্তায় অবিশ্বাস্য সরল বলে বুদ্ধি খাটিয়ে কোনো কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। মানুষের বাড়িতে জমি নিড়ানির কাজ করে দিনে কত ইনকাম হয় জানি না। তবে টাকার পরিমাণ যে ৫০-৭০ টাকার বেশি না সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
বৃদ্ধের রোজকার বাজার হচ্ছে ৫ টাকার তেল, ২৫০ গ্রাম ডাল কিংবা মটর ডাল, ৫ টাকার মরিচ, ৩ টাকার রসুন এবং ৫ টাকার পেঁয়াজ। বুদ্ধি প্রতিবন্ধি এমন খুচরা কাস্টমারকে অন্য অনেক ব্যবসায়ী হজম করেননি। যে কোনো কারণেই হোক আমরা উনাকে ফিরিয়ে দিই না। অসীম ধৈর্য নিয়ে আধা ঘন্টা সময় ব্যয় করে উনাকে ৩০ টাকার বাজার দিই।
তেল বা ডালের দাম এক বছর ধরে স্থির। বৃদ্ধের হিসেবের মধ্যেই চলে যাচ্ছিল সব। বাঁধ সেধেছে পেঁয়াজ। একটা সময় ৫ টাকায় ২৫০ গ্রাম পেঁয়াজ পেয়েছেন তিনি। হুট করে একদিন দেখলেন তাকে ২৫০ গ্রামের বদলে ১০০ গ্রাম দেয়া হচ্ছে। দু একদিনের ব্যবধানে ৫ টাকায় ৫০ গ্রাম দেয়া হলো, তারপর ৩০ গ্রাম। পেঁয়াজের জন্য বরাদ্দ ৫ টাকা থেকে একটা টাকাও বাড়ে না। বাড়ানোর উপায় নেই। পেঁয়াজের সংখ্যা কমে প্রতিনিয়ত।
আজকে পেঁয়াজের দাম বাড়তে বাড়তে চলে গেছে ২২০ টাকায়। ২২০ টাকা কেজি হলে ৫ টাকায় কয় গ্রাম পেঁয়াজ পাওয়া যায়? এই টাকায় কয়টা পেঁয়াজ পাওয়া যাবে? তাকে যখন বলা হবে আজকে পাঁচ টাকায় কোনো পেঁয়াজ নাই, তখন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মানুষটার অনুভূতি ও এক্সপ্রেশন কেমন হবে?
পেঁয়াজের দাম বাড়া নিয়ে একটা সিরিয়াস পোস্টের বিপরীতে ৯৯ টা ট্রল পোস্ট ভাসছে নিউজফিডে। ২০ টাকা দামের রোজকার অত্যাবশকীয় দ্রব্যটির দাম ১০ গুণ বেড়ে যাওয়ার মানে হচ্ছে বাজারে রীতিমতো একটি দুর্যোগ চলছে। আমরা সেই দুর্যোগকে নিয়ে নিত্য নতুন আইডিয়া বের করে ট্রল করে যাচ্ছি। ব্যাপারটা অবশ্য খারাপ না। সিরিয়াস হয়ে যদি লাভ না হয় তবে মজা করে ব্যাপারটা হালকা করাই বেটার।
আমারও বেশ কবার কয়েকটা ট্রল এলিমেন্ট এসেছিল মাথায়। যতবার ট্রল পোস্ট ভাবতে গিয়েছি ততবার ঐ বৃদ্ধ মানুষটির চেহারা চোখে ভেসেছে। আপনারা যারা ভাবছেন লোকজন পেঁয়াজ বিক্রি করে কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে তারা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছাড়া আর কিছুই না। হাতে গোণা কিছু জায়ান্ট ব্যবসায়ী হয়তো স্টক করে টাকা কামাচ্ছে। কিন্তু যারা ক্ষুদ্র বা পাইকারি ব্যবসায়ী তাদের উপর দিয়ে কী ঝড় যাচ্ছে সেটা আপনাদের ধারণার বাইরে।
একজন মানুষ আগে পেঁয়াজের যে বস্তাটি কিনত ৮০০ টাকায় সেটা এখন ৯০০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। পেঁয়াজের পেছনে যে দশগুণ বাড়তি ইনভেস্ট করতে হচ্ছে সেটার জন্য অনেকেই ব্যাংক থেকে লোন নিচ্ছে। প্রতিবার পেঁয়াজ কেনার পর আশংকা করছে লসের। ধরুন আজকে একজন ব্যবসায়ী ১৮০ টাকা কেজিতে ২০ বস্তা পেঁয়াজ কিনেছে। কালকে দাম কমে যদি ৫০ টাকায় নেমে আসে, ব্যবসায়ীটার লস কত টাকা হবে ধারণা করতে পারেন? এই যে আতংক, বাড়তি টাকা যোগানোর টেনশন সেটা ট্রলবাজরা নিশ্চয়ই ধরতে পারবেন না।
ট্রলের বিপক্ষে না আমি। পাবলিক জাজমেন্ট বহু আগে ছেড়ে দিয়েছি। ট্রল যেহেতু নিষিদ্ধ বস্তু না সেটা চলতে থাকুক। মানুষ হাস্যরসের মধ্যেই বাঁচতে শিখুক।
আপনার একদিনের ১ হাজার টাকার বাজার ১২০০ টাকা হবার দুঃখকে লাঘব করতে আপনি ট্রল করছেন, করুন। কেবল একবারের জন্য ভাবুন আজকে ৬০ বছরের একজন বৃদ্ধ ৫ টাকা নিয়ে আসবে পেঁয়াজ কিনতে। তাকে মুখ কঠিন করে আমরা বলবো, ‘৫ টাকার কোনো পেঁয়াজ নাই।’
বুদ্ধি প্রতিবন্ধী লোকটা অসহায় ও অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে পালা করে আমাদের মুখের দিকে তাকাবে। নীতি নির্ধারক কাউকেই না চেনা মানুষটা চিনে কেবল আমাদের। উনি ভাববে তাকে পেঁয়াজ থেকে বঞ্চিত করছি আমরাই। সেই দায় মাথায় নিয়ে আমরা যেভাবেই হোক, যে হিসেবেই হোক তাঁকে কিছু পেঁয়াজ হয়তো দেব।
আজকে পেঁয়াজের ধাক্কা খেয়ে কালকে হয়তো উনি আসবেন না আর।
গণপ্রজাতন্ত্রী মধ্য আয়ের বাংলাদেশের একটা এলাকায় আগামীকালকে একজন বৃদ্ধের পরিবার পেঁয়াজ ছাড়া তরকারী খাবে।
আমার কথা শেষ। লেটস ট্রল এগেইন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কিন্তু পেঁয়াজের চেয়েও ৭০ রান কম করেছে।