এই সময়ে বাংলাদেশের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম জনপ্রিয় ও আলোচিত অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মেহজাবিন চৌধুরী। শুরুটা ২০০৯ সালে লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার মঞ্চে বিজয়িনী হিসেবে। এরপরে মেহজাবিন মিডিয়া ভূবনে তার ক্যারিয়্যার শুরু করেন একজন মডেল ও অভিনেত্রী হিসেবে। মেহজাবিনের পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামে। তবে শৈশবে বেড়ে উঠেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। ও লেভেলে পড়াশুনা করার সময় তিনি লাক্স সুন্দরী নির্বাচিত হন। ব্যক্তিগত জীবনে পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়।
ইফতেখার আহমেদ ফাহমি পরিচালিত ‘তুমি থাকো সিন্ধুপারে’ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে প্রথমবারের মত টেলিভিশন অভিনেত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হন তিনি। এই নাটকে তিনি অভিনয় করেছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা মাহফুজ আহমেদের বিপরীতে। এরপর তিনি একে একে কাজ করেন ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’, ‘কল সেন্টার’, ‘মেয়ে শুধু তোমার জন্য’, ‘আজও ভালোবাসি মনে মনে’, ‘হাসো আন লিমিটেডসহ’ বেশকিছু নাটকে।
২০১৩ সালে শিখর শাহনিয়াত পরিচালিত নাটক ‘অপেক্ষার ফটোগ্রাফি’ ছিল অভিনেত্রী হিসেবে মেহজাবীনের জন্য বড় একটি টার্নিং পয়েন্ট। তবে কঠোর পরিশ্রম, অভিনয়ের প্রতি তীব্র ভালোবাসা, চরিত্রে মিশে যাবার দক্ষতা এবং মেধার সমন্বয়ে এক নতুন মেহজাবীনের দেখা পাওয়া যায় ২০১৭ সালের ঈদুল আযহায় মিজানুর রহমান আরিয়ানের পরিচালনায় ‘বড় ছেলে’ নাটকের মধ্য দিয়ে। দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয় মেহজাবিন ও জিয়াউল ফারুক অপূর্ব অভিনীত আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, প্রেম এবং বাস্তবতা নিয়ে নির্মিত ‘বড় ছেলে’।
এরপরের গল্পটা শুধুই এগিয়ে যাবার। এই সময়ে এসে একজন অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে আরো পরিপক্ক এবং দক্ষ করে তোলার প্রয়াসে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মেহজাবিন। রোমান্টিক নাটকে একচেটিয়া অভিনয় করলেও ক্যারিয়ারে একটা সময়ে এসে নানা বহুমাত্রিক চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে একজন ভার্সেটাইল অভিনেত্রীতে পরিনত করেছেন তিনি। একথা বললে ভুল হবেনা যে, টিভির পর্দা হোক বা ইউটিউব সর্বত্রই এখন মেহজাবিনময়।
দর্শপ্রিয়তার বিচারে এই সময়ের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী তিনি। অন্যভাবে বলা যায় তিশা’র পরে দিনকে দিন তিনি টেলিভিশন নাটকে একটি অপরিহার্য নাম হয়ে উঠছেন মেহজাবিন। রোমান্টিক ঘরানার নাটকে অভিনয় বেশি করলেও বেশকিছু নাটকে সফলভাবে এই ছক ভেঙেছেন তিনি। নিত্যনতুন নানা চরিত্রে অভিনয় করে প্রমান করেছেন যে, সুযোগ পেলে তিনি সব ধরনের চরিত্রেই পারফেক্ট তিনি।
তবে একজন দক্ষ অভিনেত্রী হিসেবে মেহজাবিনকে আমাদের সামনে যেকটি নাটকে উপস্থাপন করা হয়েছে তার জন্য সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেয়া যেতে পারে গুনী নির্মাতা আশফাক নিপুনকে। এই নির্মাতা-অভিনেত্রী জুটি একসাথে ‘সোনালী ডানার চিল’, ‘ফেরার পথ নে’ এবং ‘এই শহরে’র মতো অসাধারণ নাটক উপহার দিয়েছেন। এই সময়ে এসে নাটকের মান নিয়ে যেখানে খোদ ইন্ডাস্ট্রির অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যেই হতাশা, ক্ষোভ কাজ করে সেখানে বাস্তব নানা ঘটনার আলোকে এসব নাটক আমাদের মনকে ছুয়ে যায়।
চমৎকার গল্প এবং গল্পের চাহিদা অনুযায়ী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দক্ষ অভিনয়ের দেখা মেলে এসব নাটকে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাস নিয়ে ‘সোনালী ডানার চিল’ হোক বা হাসপাতাল থেকে বাচ্চা চুরি করা নার্স চরিত্রে সাবলীল অভিনয় মেহজাবীন আমাদের অবাক করেছেন বারবার। ক্যারিয়ারের আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে ‘পতঙ্গ’ । নাটকটি নির্মাণ করেছেন রাফাত মজুমদার রিকু। কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে নাটকটি।
গত ঈদুল আজহায় একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার পর দর্শক রীতিমতো থমকে গিয়েছিলো। সাধারণত রোমান্টিক নাটকে মেহজাবিনকে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত আমরা কল্পনাও করিনি যে, একজন পাগলীর চরিত্রে দেখা মিলবে মেহজাবীনের। এই চরিত্রে তার অভিনয় নিয়ে শংকা থাকলেও মেহজাবিন পেরেছেন, চিরচেনা গৎবাধা বৃত্তের বলয় ভেঙে অভিনয় করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
এ নাটকে মানবজীবনের চিরাচরিত কিছু বৈশিষ্ট্য দেখানো হয়েছে। এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করতে পেরে উচ্ছ্বসিত ছিলেন অভিনেত্রী নিজেও এমনটাই জানিয়েছিলেন একটি সাক্ষাৎকারে। এমনকি ‘কাজের বুয়া’ চরিত্রেও মানানসই ছিলেন তিনি। মাহমুদুর রহমান হিমির পরিচালনায় ‘স্বপ্ন দেখি আবারো’ শিরোনামে একটি নাটকে কাজের বুয়া চরিত্রে দেখা গেছে তাকে। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, নাটকটি মেহজাবিনের নিজের লেখা।
নাটকে কাজের বুয়া ও ড্রাইভারদের যে ঈদ উদযাপনের পরিকল্পনা থাকতে পারে সেটাই দেখানো হয়েছে। এ নাটকটিও গত ঈদে প্রচারিত হয়েছিল। এমন জীবন সাদৃশ্য গল্পের নাটক আজকাল কম নির্মাণ হয়। গুটি কয়েক যাও তৈরি হয়, নানাবিধ কারণে আলোচনায় আসে না। তবে ব্যতিক্রম ‘স্বপ্ন দেখি আবারো’। দর্শকদের ভালোবাসার স্বীকৃতিস্বরুপ টানা দু’বার মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার জয় করেছেন তিনি।
মেহজাবিন একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি সব সময়ই নিজেকে ভাঙতে চাই। প্রতিনিয়ত ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র নিয়ে দর্শকের সামনে হাজির হতে চাই। তাই রিস্ক নিয়ে কাজ করি। এই সময়ে এসে দর্শকদের চাহিদা বুঝে বা নতুনত্ব না এনে কাজ করে যাওয়াটা বোকামি। ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করাটাই একজন শিল্পীর আসল কাজ। আমি প্রতিনিয়ত অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে নতুন করেই প্রেজেন্ট করতে চাই।’
সহ-অভিনেতা হিসেবে অপূর্ব কিংবা আফরান নিশোর সাথে তার জুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এই বিষয়ে তিনি জানান, প্রথম কথা হচ্ছে- এটি আমার ব্যক্তিগত পছন্দ নয়। নির্মাতারাই আমাদের কাস্ট করেন। হয়তো এ দুজনের সঙ্গে আমার রসায়ন ভালো ও দর্শকও স্ক্রিনে আমাদের একসাথে পছন্দ করেন। তাই নির্মাতারা আমাদের নিয়েই কাজ করেন। তবে আমি ভাগ্যবতী যে, দেশের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় দু’জন অভিনেতার সাথেই আমার জুটি দর্শকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।
সম্প্রতি মেহজাবিনের ইউটিউব চ্যানেল ‘মেহজাবিন চৌধুরী’ পাঁচ লক্ষ সাবস্ক্রাইবার পেরিয়েছে। চ্যানেল নিয়ে জানতে চাইলে মেহজাবিন একটি আলাপচারিতায় বলেন, ‘আমি সবসময়ই দর্শকদের ভালোলাগাকে গুরুত্ব দেই। ২০১৮ সালের শেষের দিকে আমার মনে হয় একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলতে কেমন হয়। সেই ভাবনা থেকেই পরে খুলে ফেলি ইউটিউব চ্যানেল। তারপর শুটিং এর বিরতিতে র্যাপিড ফায়ার, টিকটক সহ অন্যান্য ভিডিও বানিয়েছিলাম। আর এখন যেহেতু সারাদিন বাসায় থাকি তাই কয়েকটি রান্নার রেসিপি, কফি এবং করনা ভাইরাস নিয়ে দুটি ভিডিও বানিয়েছি। সবাই আমার ইউটিউব চ্যানেলটিকে এতো পছন্দ করবে এটা কিন্তু আমি শুরুতে ভাবিনি। দর্শকদের ভালোবাসার জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে।’
নিজের অসাধারণ সৌন্দর্য্য, সহজাত অভিনয় প্রতিভা এবং পরিশ্রম দিয়ে অভিনেত্রী হিসেবে মেহজাবিনের জুড়ি নেই। আবার টানা একই রকম সব চরিত্র করে যাচ্ছেন – তাঁকে ঘিরে এমন অভিযোগও আছে। তবে, নিজেকে নিয়ে যাবেন সফলতার শীর্ষে এমনটাই রইলো প্রত্যাশা।