ষাটের দশকে মাত্র নয়টি ছবিতে রোমান্টিক নায়ক ছিলেন খলিল। নায়ক হিসেবে তাঁর অভিনীত সেই ছবিগুলো হলো – সোনার কাজল, প্রীত না জানে রীত, সংগম, কাজল, ক্যায়সে কুঁহু, বেগানা, ভাওয়াল সন্ন্যাসী, গোরী আর জংলী ফুল। বলাই বাহুল্য, নায়ক হিসেবে নন, বরং ক্যারিয়ার তিনি শেষ করেছেন ধুন্ধুমার এক ভিলেন হিসেবেই।
খলিলের সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয়েছিল। খুবই দিলখোলা প্রাঞ্জল মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি আজ পরলোক। একবার খলিল আমাকে বলেছিলেন, ‘১৯৫৯ সালে আনসার ডিপার্টমেন্টের – আনসার অ্যাডজুট্যান্ট পদ থেকে সাসপেন্ড হলাম। হাতে কোন কাজ নেই – অর্থ সংকট। এই কারণে ‘সোনার কাজল’ ছবিতে অভিনয় করলাম।’

ছবির প্রযোজক মাসুদ আহমেদ চৌধুরী আমাদের সিলেটেরই লোক। তিনি বললেন, খলিল তুমি তো বসে আছো – ছবির নায়ক হবে কিনা। অর্থের জন্যই সেদিন রাজি হয়ে গেলাম। আমাদের পরিবার ছিল খুবই রক্ষণশীল। ফিল্মে অভিনয় করবো – এ কথা শুনে বাবা প্রথমে আপত্তি জানালেন। বাবা তখন ছিলেন পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ডিএসপি। বাবাকে বলে কয়ে অবশেষে রাজি করালাম। ছবির পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান ও কলিম শরাফী। তাঁরা চেয়েছিলেন – ছবিতে নায়ক হিসেবে নিবেন আমিনকেই । ছবির প্রযোজক মাসুদ সাহেব বেঁকে বসলেন। এ জন্য জহির রায়হানের সেই আশা সেদিন পূরণ হয়নি। ‘সোনার কাজল’ ছবির শ্যুটিং হয়েছিল – সিলেট, ঢাকা ও সাভারে।’ যোগ করলেন তিনি।

সোনার কাজল ছবিতে খলিল ছিলেন গ্রামের ছেলে। শহরে এসে তাঁর পরিচয় হয় আধুনিকা মেয়ে সুলতানা জামানের সঙ্গে। হৃদ্যতা ও ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল দু’জনার মধ্যে। কিন্তু, অবশেষে ছবির কাহিনী অনুযায়ী খলিলের সঙ্গে মিলন হলো গ্রামের মেয়ে সুমিতা দেবীর।
খলিলের জন্ম তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী ছিল ১৯৩২ সালের দুই ফেব্রুয়ারি, সিলেটে। তাঁর পুরো নাম খলিল উল্লাহ খান। ম্যাট্রিক মানে আজকের এসএসসি পাস করেছিলেন ১৯৪৮ সালে সিলেট জিলা স্কুল থেকে। তাঁর বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন বিধায় শৈশবে মেদিনীপুর সহ বহু জায়গায় থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল।
মেদিনীপুরে বহু দিন থেকেছিলেন – এ জন্য তাঁর কাছে, ‘মেদিনীপুর ছিল বড়ই স্মৃতির শহর।’
যতবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ততবারই তিনি, মেদিনীপুরের স্মৃতি চারণ করেছিলেন। শেষ বয়সে তিনি একবার মেদিনীপুরে গিয়েছিলেন, সে কথাও তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন। খলিল মারা যান ২০১৪ সালের সাত ডিসেম্বর ঢাকায়।

খলিল অভিনীত ছবির সংখ্যা শতাধিক। খলিল অভিনীত উল্লেখযোগ্য কিছু ছবির তালিকা দিচ্ছি।
- সোনার কাজল। মুক্তি ১৯৬২ সালের ১২ জানুয়ারি। ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন – সুমিতা দেবী ও সুলতানা জামান।
- প্রীত না জানে রীত। মুক্তি ১৯৬৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর। তাঁর নায়িকা ছিলেন – শবনম।
- সংগম। মুক্তি ১৯৬৪ সালের ২৩ এপ্রিল। তাঁর নায়িকা ছিলেন – সুমিতা দেবী।
- কাজল। মুক্তি ১৯৬৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন – শবনম।
- ক্যায়সে কাহু। মুক্তি ১৯৬৫ সালের ৮ অক্টোবর। ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন – শবনম।
- কার বউ। মুক্তি ১৯৬৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি।
- বেগানা। মুক্তি ১৯৬৬ সালের ৮ জুলাই। ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন – শবনম।
- ভাওয়াল সন্ন্যাসী। মুক্তি ১৯৬৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর। ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন – রেশমা।
- জংলী ফুল। মুক্তি ১৯৬৮ সালের ২৯ মার্চ। ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন – সুলতানা জামান।

খলিল অভিনীত আরো কয়েকটি ছবির মধ্যে – বিনি সুতার মালা, ওয়াদা, বউ কথা কও, সোনার চেয়ে দামী, মেঘের পরে মেঘ, মধুমতী, গুন্ডা – আরও কত কি।
১৯৭৬ সালে ‘গুন্ডা’ ছবির জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ‘শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা’র পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি আজীবন চলচ্চিত্র সন্মাননা ও একুশে পদকও পেয়েছিলেন জীবদ্দশায়। টেলিভিশনের নাটকে খলিল উল্লাহ খান ছিলেন একজন শক্তিমান অভিনেতা। আব্দুল্লাহ আল মামুনের ধারাবাহিক নাটক ‘সংশপ্তক’ নাটকের কথা এখানে না বললেই নয়। বাংলাদেশের বিনোদন জগৎ তাই তাঁকে নানা রূপেই স্মরণ করতে পারে।
