হিট দেব কিংবা ‘বাজারী’ দেব

‘ঢাকের তালে কোমর দোলে, খুশিতে নাচে মন, আজ বাজা কাঁসর জমা আসর মা থাকবে আর কতক্ষণ’ – অভিজিৎ এর গাওয়া এই গানটি দুর্গাপূজা এলেই সব প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বেজে উঠে। দশ বছর আগে গাওয়া ‘পরাণ যায় জ্বলিয়া রে’ সিনেমার এই গানটির বেশ জনপ্রিয়তা। এই সিনেমায় নায়ক এই গানের তালে নেচে নিজেকে আরো জনপ্রিয় করেছিলেন।

‘আই লাভ ইউ’ সিনেমার সেই ভালোবাসার জন্য মাঠে কাজ করা একদিন ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শঙ্কর হয়ে আফ্রিকা জয় করেছেন। ‘রিমঝিম এই ধারা তে, চায় মন হারাতে’, বৃষ্টি ভেজার ‘প্রেমের কাহিনী’, শুনিয়ে হয়েছেন ‘দুই পৃথিবী’র পরিক্ষীত বিশু। তিনি বাংলার খোকাবাবু থেকে পাগলু, চ্যালেঞ্জ জয়া করা চ্যাম্প ভারতীয় বাংলা সিনেমার অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক ‘দেব’।

আসল নাম দীপক অধিকারী। ডাক নাম রাজু। জন্ম মুম্বাইয়ে, বেড়ে ওঠাও সেখানেই। বাবা হিন্দি সিনেমার নির্মানের সহকারী হয়ে টুকটাক কাজ করতেন। সেখান থেকে পাড়ি জমিয়ে এলেন কলকাতায়, প্রথম সিনেমা তখনকার হিট নায়িকা রচনা ব্যানার্জীর সঙ্গে ‘অগ্নিশপথ’, কিন্তু ফ্লপ।

সিনেমার আশা বোধহয় ছেড়ে দিয়েছিলেন, ঠিক তখনই ভেঙ্কটেশের প্রধান তাকে দিলেন আবার নায়ক হওয়ার সুযোগ। রবি কিনাগী পরিচালিত সিনেমার নাম ‘আই লাভ ইউ’। মুক্তির পর পেল সুপারহিটের তকমা। ভেঙ্কটেশ নিজেও বোধহয় ভাবেন নি,এত জনপ্রিয়তা পাবে,দেব তো কস্মিনকালেও না। তবে দর্শকদের অভিযোগ, নায়কের অভিনয় একেবারেই ভালো না, এমনকি সেইরকম সুদর্শন নন। এই সমালোচনাকে মাথায় রেখে মুম্বাই গিয়ে ভর্তি হলেন অভিনয় কোর্সে, ফিরে এসে করলেন ‘প্রেমের কাহিনী ও মন মানে না’ – এটিও সফল।

চ্যালেঞ্জ থেকে পরাণ যায় জ্বলিয়ারে, পরপর দুটি সুপারহিট সিনেমা তাকে নিয়ে আসে শীর্ষে। অভিনয়ের উন্নতি নেই, উচ্চারণে সমস্যা তবুও তিনি জনপ্রিয়। শিশুদের কাছে তো আরো বেশি প্রিয় গেলেন, তখনকার অনেক তরুণীই তাঁর ভক্ত বনে গেলেন। নাচ টা খুবই ভালো জানেন, এটা ছিল সবচেয়ে ভালো দিক। আর দেবের সিনেমা মানেই যেন জনপ্রিয় সব গান। আইটেম সং থেকে রোমান্টিক কিংবা বিরহের গান সবগুলোই হতো সুপারহিট।

সাফল্যের হাওয়ায় যখন উড়ছে,তখন নিজের প্রতি ঝুঁকি নিলেন ‘দুই পৃথিবী’ সিনেমায়। তৎকালীন সেরা সুপারস্টার জিৎ এর সঙ্গে একই সিনেমা হাজির হলেন,সবাই ভেবেছিল তিনি হয়তো জিৎ এর সঙ্গে পাত্তাই পাবেন না। তবে মুক্তির পর দেখা গেল ভিন্নচিত্র, দর্শকরা দেবের অভিনয়েই বেশি মুগ্ধ হয়েছে।

পরিচালক রাজ চক্রবর্তী ঠিকই তাঁর থেকে অভিনয় বের করে এনেছিলেন। এই সিনেমার রেশ না কাটতেই এলো ‘পাগলু’। আহামরি কোনো সিনেমা না হয়েও এটি নাম লেখায় রেকর্ডভাঙা সফলের খাতায়। দর্শকদের সাথে খ্যাত হন ‘পাগলু’ নামে। কাছাকাছি সময়ে মুক্তি পাওয়া লে ছক্কা, দুজনে, সেদিন দেখা হয়েছিল, রোমিও, খোকাবাবু সিনেমা গুলোতে।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই সবগুলোই রিমেক সিনেমা, সফল হলেও ধীরে ধীরে একঘেয়ে হয়ে উঠে। পাগলু ২, চ্যালেঞ্জ ২, খোকা ৪২০, রংবাজ সিনেমাগুলো হয়তো বানিজ্যিক ভাবে সফল, কিন্তু কোনো বৈচিত্র্য ছিল না। ঠিক এমন সময় এলো বিশাল বাজেটের সিনেমা ‘চাঁদের পাহাড়’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই জনপ্রিয় উপন্যাসকে চিত্ররুপ দিলেন কমলেশ্বর চট্টোপাধ্যায়।

সমালোচকরা যে সন্তুষ্ট ছিলেন তা নয় তবে এমন আয়োজনকে বাহবা দিয়েছিলেন, বানিজ্যিক ভাবেও রেকর্ড করলো। দেব যেন পেলেন ক্যারিয়ারের নতুন গতিপথ, নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা হয়তো সেখান থেকেই, কিছুদিন পরেই মুক্তি পেল সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস থেকে অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীর ‘বুনোহাঁস’। সিনেমা ফ্লপ হলেও দেব পেয়েছিল ভূয়সীবা প্রশংসা।

তবে রিমেক থেকে যেন নিজেকে ছাড়াতে পারছিলেন না। বিন্দাস, হিরোগিরি চলেনি, এর মধ্যে কাঁটা হয়ে উঠলো ‘যোদ্ধা’র মত দূর্বল রিমেক। যার জন্য আজো হাস্যরসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ‘শুধু তোমারি জন্য’ অবশ্য কিছুটা আলোচনায় এসেছিল।

সৃজিত মূখ্যার্জির তারকাবহুল ‘জুলফিকার’, হিট হলেও দর্শকদের হতাশা করেছিল, তবে মুগ্ধ করেছিলেন দেব, তাতে নিজের কোনো ডায়লোগ না থাকার পরও। অপর্ণা সেনের ‘আরশিনগর’ ও গেল ফ্লপের খাতায়, প্রশংসিতও হয় নি। বড় আশা নিয়ে করেছিলেন কৌশিক গাঙ্গুলীর ‘ধূমকেতু’, সেটা আজো মুক্তি পেল না।

এরপর ‘চ্যাম্প’ দিয়ে নিজেকে নতুন ভাবে পরিচিত করলেন প্রযোজক রুপে। নিজের সেই রিমেকের ধারা ভেঙে মনোযোগী দিলেন মৌলিক গল্পে। এই সিনেমা খুব সফল হয়েছে তা বলা যাবে না, তবে প্রযোজক দেব ভিন্নকিছু দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ‘আমাজন অভিযান’ – সেই সময়ে স্বস্তির ধারা এনে দিয়েছিল, দারুণ ব্যবসা করেছিল।

একে একে এল ককপিট, কবির, হইচই আনলিমিটেড, কিডন্যাপ আর পাসওয়ার্ড। নিজের প্রযোজিত কোনো সিনেমায় সুপারহিট হয় নি, সবচেয়ে প্রশংসিত ‘কবির’ তো সুপারফ্লপই। তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছেন, একদিন সফল হওয়ার বাসনায়। দর্শকরা তাঁকে গ্রহণ করবেন নিজের মতো করে, নিজের ও ভুলত্রুটি গুলো কাটিয়ে উঠবেন। সম্প্রতি মুক্তি পেল ‘সাঁঝবাতি’, প্রশংসার পাশাপাশি ব্যবসাও করছে শুনেছি।

দেবের অভিনয় আগের চেয়ে বেশ উন্নত হয়েছে, তবে উচ্চারণের সমস্যাটা প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছেন, এর মধ্যে পরপর দু’বার সাংসদ হয়ে নিজেকে ব্যস্ত করেছেন রাজনীতিতে। সব কিছু মিলিয়ে দেবের ক্যারিয়ারের আবার প্রত্যাবর্তন ঘটুক, সেটাই প্রত্যাশা।

সাফল্য অনেক হলেও অভিনয় কিংবা ছবি নির্বাচন – কোনো দিক থেকেই দেব ঠিক সেরা কেউ নন। তবে, একা কথা সত্যি যে তিনি বিপুল জনপ্রিয়, তিনি সর্বস্তরের নায়ক। কলকাতার হাই সোসাইটির পার্টিতে যেমন তাঁর ছবির গান বাজে, তেমনি বাংলাদেশের কোনো মফস্বলের তার ছবি আঁকা টি-শার্ট পরে তরুণদের হাঁটতে দেখা যায়। এটাই হয়তো দেবের সবচেয়ে বড় সাফল্য। তাই, ‘বাজারী’ বলে যতই তাঁর একটা নিন্দা থাকুক না কেন, নিজের কাজটায় সফল তিনি।

সর্বশেষ