সিনেমা দিয়ে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না!

১.

না, আমি কখনোই মনে করি না নেটফ্লিক্সের একটা টিপিকাল হলিউড অ্যাকশন সিনেমা আমার দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে দিতে পারে। যে দেশে করোনার সময়ে চাল চুরি হয় আর ১০ বছরের মেয়ে ভাত খেতে না পেরে অভিমানে আত্মহত্যা করে, সেই দেশের ভাব কী আর মূর্তিই বা কী, সেইটা আমার জানা নাই আসলে।

২.

নিজের দেশের কোন অভিনেতাকেই (যাদের যোগ্যতা আছে) আমরা এখন পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে দেখতে পারলাম না। এই যুগে শুধু যোগ্যতা থাকলে হয় না, নিজেকে কীভাবে বেচতে হয় সেটাও জানা লাগে – কথাটা আমার না, এক্সট্র‍্যাকশনে দুই মিনিটের জন্য অভিনয় করা পঙ্কজ ত্রিপাঠির। এই রোলে অভিনয় করার মত অনেক ঝানু অভিনেতা আমার দেশে আছে, কিন্তু তাদের সেরকম ব্র্যান্ডিং করা হয় নাই কখনও।

আমাদের দেশের খুব কম অভিনেতার কোন কাজ ইংরেজি সাবটাইটেলসহ আপনি অনলাইনে পাবেন। ইংরেজি সাবটাইটেল-সহ কাজ না থাকলে কিভাবে বাইরের দেশে মানুষের কাছে তুলে ধরব নিজেদের? বাংলা ভাষা শিখিয়ে এরপরে? পঙ্কজ ত্রিপাঠির ওই রোল ইজিলি আমাদের তারিক আনাম খান করতে পারতেন, যার ছেলে এই সিনেমার প্রোডাকশনের কাজে জড়িত ছিলেন। অথচ অনলাইনে আপনি তারিক আনাম খানের একটা কাজ ইংরেজিতে সাবটাইটেল-সহ পাবেন না।

আমার অনেক স্টুডেন্ট তারিক আনাম খান কে চেনে না, অথচ প্রায় কাছাকাছি বয়সের পঙ্কজকে চিনে অ্যামাজনের মির্জাপুরের মাধ্যমে। কারণ একটাই – পিআর বা ম্যানেজারের আর অবশ্যই কাজের মাধ্যমে পঙ্কজ আমার স্টুডেন্টের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে যা আমার দেশের শিল্পীরা পারে নাই। ফলে, পঙ্কজ অ্যামাজনেও কাজ করেন, আবার নেটফ্লিক্সেও কাজ করেন যেখানে এক অর্থে নেটফ্লিক্স আর অ্যামাজন একজন আরেকজনের রাইভাল।

৩.

১২ মিনিটের আনকাট যে অ্যাকশন সিকুয়েন্সটা এই সিনেমাতে আছে (কার চেজ, ফুট চেজ,আরেকটা কার চেজ, গোলাগুলি, এরপরে ছুরির যুদ্ধ, এরপরে হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট আর এরপরে বোমা বিস্ফোরণের দৃশ্য), সেটা করার জন্য রণদীপ হুদা দুই সপ্তাহের উপরে সময় দিয়েছিলেন প্র‍্যাকটিস করার জন্য। চিন্তা করা যায়? এই পরিমাণ ডেডিকেশন আমাদের দেশের সব শিল্পী দেখাবেন না।

সেই চর্চাটাই বা সেই চর্চার প্র্যাকটিস এখানে সেভাবে গড়েই ওঠে নাই এখনো। তারমানে এই না যে একেবারেই নেই। মিশন এক্সট্রিমের জন্য আরিফিন শুভ প্রায় ১১ মাস সময় দিয়েছেন সব মিলিয়ে, এই সময়ে আর অন্য কোন কাজ করেন নাই। নিজের পরের সিনেমা ‘শান’ এর জন্য সিয়াম আহমেদ ইসরায়েলের বিশেষ মার্শাল আর্ট ‘ক্রাব মাগা’ শিখছেন।

অর্থাৎ, তাদের মাঝে চেষ্টাটা আছে। কিন্তু এই চেষ্টার কথাগুলো ফেসবুকে বলে আসলেই লাভ নাই, এটাকে ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে পৌঁছাতে হবে। লিংকড ইনে অভিনেতাদের সবসময় নিজের এইসব কাজের ব্যাপারে আপডেট দিতে হবে। নিজের কমপক্ষে একজন হলেও ম্যানেজার বা পিআর এজেন্ট রাখতে হবে যারা এইসব ব্যাপার ইন্টারন্যাশনাল প্রোডাকশন হাউজের কাছে তুলে ধরবেন।

রণদীপ হুদার ক্যারেক্টার ইজিলি আমাদের আরিফিন শুভ করতে পারতেন, আর শুভর বর্তমান বডি স্ট্রাকচার নিঃসন্দেহে রণদীপ হুদার চেয়ে অনেক বেটার। ক্রিসের মত মাস্কুলার হিরোর পাশে আমাদের মাস্কুলার শুভকে ছুরি দিয়ে মারামারি করতে দেখলে বরং আরও বেশি ভালো লাগতো। কিন্তু সেটা ততক্ষণ পর্যন্ত হচ্ছে না যতক্ষণ না আপনি নিজেকে প্রোপ্রারলি অন্য দেশের দর্শকের সামনে তুলে ধরতে পারছেন। নেটফ্লিক্স কখনোই আপনার ফেসবুক আইডি বা পেজে এসে নক দিবে না- শুনলাম আপনি নাকি বাংলাদেশের অনেক পপুলার একজন নায়ক, তা অভিনয় করবেন নাকি আমাদের পরের প্রোজেক্টে?

রুশো ব্রাদার্স কয়েকমাস আগেও সালমান খানের প্রশংসা করেছিল বিশেষ করে সালমানের সিনেমার একশনের। আপনার কি মনে হয় রুশো ব্রাদার্স সারাক্ষণ সালমান খানের সিনেমা খুঁটিয়ে দেখে? জি না, বরং সালমান খানের চমৎকার পিআর এজেন্টদের কাজ হচ্ছে তার কাজ ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে তুলে ধরা আর সেখান থেকেই তা জেনে যান রুশো ব্রাদার্স। জ্যাকলিন ফার্নান্দেজের মত একটা মধ্যম মানের অভিনেত্রীরও আটজনের মত পিআর আছে, আর আমাদের?! আটজনের খরচ সামলাতে না পারি, একজন তো অন্তত ম্যানেজ করতে পারি? নাকি এখনও জানিই না যে পিআর জিনিসটা কী?

৪.

এই দেশে আউটডোরে শুটিং করতে যাওয়ার চেয়ে খুব সম্ভবত একজন মানুষকে ছিনতাই করা সহজ। কোন প্রসেস নাই সুন্দর করে শুটিং করার। আপনার ক্ষমতা আর উপরের লেভেলের মানুষের সাথে আপনার কানেকশন থাকলে আপনি বাইরে শুটিং করতে পারবেন, এছাড়া শান্তিতে কাজ করতে পারবেন না (নিজে যা কাজ করেছি সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি) একটা শুটিং মানে যে কী পরিমাণ আয়োজন আর ধকলের কাজ, সে ব্যাপারে সিংহভাগ মানুষের কোন ধারণা নাই।

তার উপরে নিরাপত্তাহীনতার ব্যাপার তো আছেই। কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটকের ধর্ষিত হওয়া বা বিপদে পড়ার সংবাদ মাঝেমাঝেই দেখি। এসব কারণেই এই দেশে শুটিং এর রিস্ক নিতে চায় না বাইরের কেউ। ফলাফল- আরেক দেশে সেট বানিয়ে ঢাকা বুঝানো হয়। আর ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়।

নিজের ওজনের চেয়েও বেশি অনেক ভারি কথা বলে ফেলসি সম্ভবত। এবার কিছু হালকা কথা বলি।

৫.

সবচেয়ে মেজাজ খারাপ লাগসে পুরান ঢাকায় একটা বিরিয়ানির দোকান দেখায় নাই সিনেমাতে। শুধু ‘প্রমাণ দাও’ না বলে যদি ক্রিস আজকে ‘প্রমাণ দাও অথবা নান্নার বিরিয়ানি খাওয়াও’ বলতো, বেশিরভাগ বাঙালির আজকে কোন অভিযোগ থাকতো না এই সিনেমা নিয়ে। দুইদিন পর এমনেও থাকবে না। আমাদের এই যাবতীয় উত্তেজনা অল্প কিছু সময়ের জন্য।

আমাদের যাবতীয় ক্ষমতা আইএমডিবিতে গিয়ে এই সিনেমাকে ১০ এ ১ রেটিং দেয়ার মাঝে সীমাবদ্ধ। নতুন ইস্যু পেলে আবার ঝাপিয়ে পড়ে দুইভাগ হয়ে যাব। থর সিরিজের নতুন সিনেমা আসলে ক্রিসের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করা জাতি আবার লাইনে দাঁড়াব তার সিনেমার জন্য।

৬.

এক্সট্র‍্যাকশনের সিকুয়েলের আইডিয়া দিতে পারি। ক্রিস বনাম ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী। ক্রিস যদি বাঁইচা ফিরে আসতে পারে, তাইলে বুঝব সে আসল পুরুষ!

সর্বশেষ