ঢাকার সপ্তদশ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এ উৎসবে ৭২ টি দেশের বিভিন্ন ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। অন্য দর্শকের মতো আমিও ঢাকার অলিয়াস ফ্রঁসেজে সৃজিত মুখার্জির ‘এক যে ছিল রাজা’ দেখতে গিয়েছিলাম। শো’র সময় ছিল বিকাল চারটা। প্রায় সোয়া তিনটায় গিয়েও সীমিত আসনের জন্য আমি প্রেক্ষাগৃহে ঢুকতে পারলাম না। শুধু আমি নই, আমার সাথে আরো অনেকেই ব্যর্থ হয়েছিলেন।
দর্শকের আগ্রহ দেখে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় একই ছবি সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় আবার দেখানো হবে, যাঁরা এসেছেন তাঁদের বিশেষ ‘পাস’ দেয়া হবে। দর্শকের তুমুল আগ্রহ দেখে বেশ ভাল লাগলো।
হুট করে পাওয়া পাসে সিদ্ধান্ত পাল্টে সন্ধ্যার শো দেখলাম।একদম সামনের সারিতে অচেনা সিনে দর্শকের সাথে বসে উপভোগ করলাম আড়াই ঘন্টার চলচ্চিত্র, ‘এক যে ছিল রাজা’।
ছবিটি দেখার কয়েকটি কারণ ছিল। বহুল প্রচলিত ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা, জয়া আহসান এবং সৃজিত মুখার্জি – এই তিনটি বিষয়ই যথেষ্ঠ ছিল ছবিটি দেখার জন্য।
ছবিটি দেখার পর আরো একজনের প্রতি ভালোলাগা কাজ করছে, তিনি যিশু সেনগুপ্ত।
ছবির মূল গল্প ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা নিয়ে। কোর্টরুম ড্রামার ফাঁকে ফাঁকে উঠে এসেছে বিক্রমপুরের মেজ কুমারের ইতিহাস। বহুল প্রচলিত এ গল্প নতুন করে চিত্রিত করেছেন সৃজিত।
চিত্রনাট্য ছিল উপভোগ্য। সংলাপে প্রয়োজনীয় রস ছিল। আবার কিছু সংলাপে ছিল কাঠিন্য। তবে কিছু কিছু সংলাপ শুনে, কিছু কিছু দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে ওসব না হলেও চলতো। গল্পের দৃশ্যায়ন ঠিকঠাক ছিল, তবে সময়ের দিকে নজর রাখতে পারতেন সৃজিত। প্রায় আড়াই ঘন্টাকে কমিয়ে দুই বা সোয়া দুই ঘন্টায় নিয়ে আসা যেত অপ্রয়োজনীয় দৃশ্যকে পাশে সরিয়ে রাখলে।
সৃজিতের নির্মাণ প্রশংসনীয়, বিশেষ করে সাদা-কালো আদালতকে এক লহমায় রঙিন করে দেয়ার ক্ষণটি ছিল দৃষ্টিনন্দন। গল্পের সাথে সে সম্পাদনাটি ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ছবিতে দুজন নারী নজর কেড়েছেন। একজন জয়া আহসান, অন্যজন অপর্ণা সেন।
মেজ কুমারের বোন মৃন্ময়ী দেবীর চরিত্রে জয়া ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। জীবনের তিনটি ধাপে তিনি পর্দায় এসেছেন। যুবতী, প্রৌড়া ও বৃদ্ধা। তিনটি রূপেই জয়া অনন্যা। বয়সের সাথে কণ্ঠের পরিবর্তন হয়, জয়ার সংলাপ প্রক্ষেপণে ব্যাপারটি লক্ষ্য করা যায়। ভাইয়ের জন্য বোনের আবেগ, ভাইয়ের বিরহে বোনের হৃদয়ের দহন – জয়া ব্যাপারগুলো তুলে ধরেছেন দক্ষতার সাথে। তিনি চরিত্রের সাথে মিশে যাবার এক প্রাকৃতিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন, জাত অভিনেত্রী জয়ার অভিনয় ছিল এ ছবি দেখে আমাদের জন্য বিশেষ পাওয়া।
অপর্ণা সেন এ বয়সেও অভিনয়ের জাদুতে মুগ্ধ করে চলেছেন। বড়পর্দায় তাঁকে দেখছিলাম আর মুগ্ধ নয়নে অভিনয় উপভোগ করছিলাম। অঞ্জন দত্তের সাথে তার তর্ক, বিবাদিপক্ষের আইনজীবি হিসেবে তুখোড় যুক্তি খন্ডন ছিল চমৎকার।
এ ছবির অন্যতম আকর্ষণ যীশু সেনগুপ্ত। তাঁর অভিনয় ছিল বেশ উপভোগ্য। চরিত্রানুযায়ী তাঁকে সাজিয়ে উপস্থাপন করতে পেরেছেন সৃজিত যথাযথভাবে। বয়সের বিভিন্ন স্তরে যীশু নিজেকে ভেঙেছেন, তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনিই রাজা মহেন্দ্রকুমার চৌধুরী।
অন্যান্য চরিত্র তাঁদের মতো করে অভিনয় করে গেছে। মেজ কুমারের ডাক্তার, শ্যালক, স্ত্রী, রক্ষিতা সকলেই আপনগন্ডিতে চেষ্টা করে গেছে। শ্যালক ও ডাক্তারের চরিত্রকে নির্মাতা চাইলে আরেকটু বিস্তৃত করতে পারতেন, তাহলে মন্দ হতো না। রুদ্রনীল ও অনির্বাণের মতো দুজন অভিনেতাকে দীর্ঘসময় পর্দায় দেখতে চাইতেই পারে দর্শক।
রক্ষিতার চরিত্রে শ্রীনন্দা সঙ্কর বেশ সাবলিল ছিলেন। মেজকুমারের স্ত্রীর চরিত্রে রাজনন্দিনী পালও চেষ্টা করেছেন নিজের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে।
পরিশেষে মনে হয় ‘এক যে ছিল রাজা’ মনকে ঠিক তৃপ্ত করতে পারেনি, প্রত্যাশা অনেক ছিল বলেই হয়তো। তবে সৃজিতের কর্মের প্রশংসা করতেই হয়, মেধার ছাপ আরো একবার রেখেছেন নির্মাতা। চিত্রনাট্য ও সম্পাদনায় আরেকটু মুন্সিয়ানা দেখালে ছবিটির মান আরো উঁচুতে উঠে যেত নিশ্চিন্তে।
এ ছবির প্রাপ্তি দুজনা, যীশু সেনগুপ্ত ও জয়া আহসান। ছবিটি দেখতে হলে তাঁদের জন্যই দেখতে হবে। জয়া আরো একবার প্রমাণ করেছেন শিল্পীর কোন কাঁটাতার হয়না, তিনি সকলের। অন্যদিকে যীশু একাধারে উপস্থাপক, অভিনেতা, নায়কের পর নিজের সিভিতে আরেকটি উপাধি চাইলেই যোগ করতে পারেন, তিনি ‘রাজা মহেন্দ্র কুমার চৌধুরী’।
সুযোগ থাকলে ‘এক যে ছিল রাজা’ দেখে নিন, ইতিহাস আশ্রিত চলচ্চিত্র খুব একটা হতাশ করবেনা; তবে বেশি প্রত্যাশা করাও ঠিক হবে না।