খৈয়াছড়া ঝর্ণার নাম নিশ্চয়ই কমবেশি সবাই শুনেছেন। ঝর্ণা জিনিসটা প্রথম দেখি মৌলভীবাজারে। মাধবকুন্ড ইকোপার্কের ‘ওয়াচ টাওয়ার’ থেকে যখন ঝর্ণাটা চোখে পড়ে তখন থেকেই আমি ঝর্ণার প্রেমে পড়ে যাই। ঝর্ণা দেখার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সময় স্বল্পতার কারণে ফেসবুকে শুধু অন্যদের দেওয়া বিভিন্ন ঝর্ণা ট্র্যাকিংয়ের ছবিতে লাইক দিয়েই আমার দিন কাটতে লাগলো। হঠাৎ একদিন ফেসবুকের একটি গ্রুপে এক ভাই এর পোস্ট দেখলাম। পোস্টের শিরোনাম ছিলো এরকম, ‘এক দিনে ঘুরে আসুন ঝর্ণার রাজ্য থেকে’। ডিটেইলসে গিয়ে দেখলাম ঝর্ণার নাম খৈয়াছড়া। অবস্থানঃ বড়তাকিয়া বাজার, চট্টগ্রাম। ব্যাস! আমাকে আর পায় কে?
যেভাবে যাবেন
একদিনেই খৈয়াছড়া ঝর্ণা ঘুরে আসা যায় অনায়াসে। ধরুন আপনি শুক্রবারে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন, তাহলে বৃহস্পতিবার রাত্রে আপনাকে ঢাকা থেকে রওনা দিতে হবে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। শুক্রবার ঝর্ণা দেখে শনিবার সকালের আগেই বড়িরে ফিরে আসতে পারবেন।
খৈয়াছড়া ঝর্ণায় যাওয়া যায় দু’ভাবে।
রুট ১: ঢাকা থেকে ১১.৩০ অথবা ১২ টার চট্টগ্রামের বাসে উঠে পড়বেন। ভাড়া ৪৮০ টাকা (নন এসি)। বাসের সুপারভাইজারকে বলবেন খৈয়াছড়া মুখে নামবো। প্রায় সব সুপারভাইজারই খৈয়াছড়া মুখ চিনে। যদি না চিনেন তাহলে বলবেন বড়তাকিয়া বাজারে নামিয়ে দিতে। বাস সকাল ৫-৬ টার মধ্যেই পৌঁছে যাবে বড়তাকিয়া বাজার। বড়তাকিয়া বাজার থেকে উল্টো দিকে মানে ঢাকার দিকে ১ মিনিট হাঁটলেই দেখবেন খৈয়াছড়া ঝর্ণার একটি সাইনবোর্ড। এই রাস্তায় সি.এন.জি/নসিমন পাওয়া যায়। এগুলো দিয়ে যতটুকু রাস্তা আছে ততটুকু যাওয়া যায়। ভাড়া ১৫-২০ টাকা। সি.এন.জি থেকে নামার পর মাটির রাস্তা দেখা যাবে। সেই রাস্তা ধরে এগুলেই ঝর্ণার দেখা মেলবে। যাওয়ার সময় পুরোটা রাস্তা হেঁটে যাওয়াই ভালো। গ্রামের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে ও সকালের স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে লাগিয়ে হাটাই তো উত্তম।
রুট ২: ঢাকা থেকে ফেনীর বাসে উঠে ফেনীর মহিপালে নামবেন। বাস ভাড়া ২৭০ টাকা (নন এসি)। মহিপাল এ ভোর থেকে চট্টগ্রাম বা অন্যান্য লোকাল বাস চলে। সেগুলোতে ৪০-৬০ টাকা করে যাওয়া যায় একেবারে খৈয়াছড়া মুখে। সেখানে পৌঁছোতে এক থেকে দেড় ঘন্টার মত সময় লাগে। এই রুটে খরচ কম হলেও ঝামেলা একটু বেশি। যেমন: রাস্তায় যদি জ্যাম না থাকে তাহলে বাস ফেনী পৌঁছে যায় সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টার মধ্যে। অর্থাৎ ফেনী নেমে আপনাকে ভোর হওয়ার জন্য ২ ঘন্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে। তাই রুট ১ বেছে নেয়াই ভালো। রুট ১ এ গেলে আপনি খৈয়াছড়ায় পৌঁছাবেন একবারে ভোরে।
কখন যাবেন
ঝর্ণা দেখতে যাওয়ার উত্তম সময় হলো বর্ষাকাল। এই ঋতুতে ঝর্ণার সৌন্দর্য্য যেমন হাজারগুন বেড়ে যায় তেমনি আশেপাশের পরিবেশও আরো সুন্দর হয়ে যায়। বর্ষায় পাহাড়ি পথ পাড়ি দেওয়া কষ্টকর বটে। তবে খৈয়াছড়া ঝর্ণার সৌন্দর্য্যের কাছে আপনার এই কষ্ট মোটেও কষ্ট মনে হবে না।
যা যা সাথে নিবেন
১. সবচেয়ে জরুরি হলো ট্র্যাকিং স্যান্ডেল বা এমন স্যান্ডেল যেগুলো ভালো গ্রিপ করতে পারে। সাধারণ স্যান্ডেল বা স্লিপার পরে গেলে আপনকে পস্তাতে হবে।
২. হালকা শুকনো খাবার যেমনঃ খুরমা, ম্যাংগো বার ইত্যাদি।
৩. খাবার পানি নিয়ে যাবেন। বড়তাকিয়া বাজার থেকে পানি কিনে নিলেই হবে।
৪. ট্রাউজার বা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট এবং নরমাল টি-শার্ট পরে নেয়াই ভালো। কারণ ভিজা কাপড়ে ট্র্যাকিং করতে হয়।
৫. বৃষ্টি হলে খৈয়াছড়া ঝর্ণায় জোঁক দেখা যায়। তাই জোঁক আক্রমণ করলে তা থেকে রেহাই পাবার জন্য সামান্য লবন নিয়ে নিবেন সাথে করে। সাথে এংলেটও নিয়ে নিতে পারেন।
৬. বৃষ্টির দিন হলে সাথে করে রেইনকোট অবশ্যই নিতে হবে।
৭. সাথে নেওয়া ব্যাগপ্যাক যথাসম্ভব হাল্কা রাখার চেষ্টা করবেন। কারণ এটি নিয়ে আপনাকে ২/৩ ঘন্টা হাঁটতে হবে।
ঝর্ণাটা আসলে কেমন?
ঝর্ণার বিবরণ পড়তে ব্যক্তিগতভাবে আমার একদমই ভালো লাগে না। কারন আমি চাই, যে ঝর্ণা আমি দেখতে যাবো তার রূপ নিজের চর্মচক্ষু দিয়ে উপভোগ করতে। আমার মত আরো অনেকেই হয়ত এমন। তবে অনিচ্ছাসত্ত্বেও খৈয়াছড়া ঝর্ণার বিবরণ একটু জেনে নেয়া প্রয়োজন কারণ অনেকেই কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়া খৈয়াছড়া ঝর্ণায় গিয়ে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হন।
খৈয়াছড়া ঝর্ণা একটি ঝর্ণা হলেও এর ধাপ হলো ১২ টি। পাহাড় বেয়ে বেয়ে একটি একটি করে ধাপ দেখতে হয়। তাই একে খৈয়াছড়া ট্রেইলও বলা হয়। ১২ টি ঝর্ণার পাশাপাশি এই ট্রেইলে রয়েছে ছোট বড় অনেক ঝিরিপথ। খৈয়াছড়া মুখ থেকে খৈয়াছড়া ঝর্ণায় হেঁটে যেতে সময় লাগে প্রায় দেড় থেকে দুই ঘন্টা। পাহাড়ি রাস্তায় পাখির কিচিরমিচির, ঝিরিপথের পানি পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে দুই ঘন্টা ট্র্যাকিং এর পর চোখে পড়ে ঝর্ণার প্রথম ধাপ। দু’ঘন্টা ট্র্যাকিং করে ক্লান্তি নিয়ে যখন ঝর্ণার ঠান্ডা পানিতে গাঁ ভিজাবেন তখন দেখবেন শরীরের সব অবসাদ আর ক্লান্তি ঝর্ণার পানির ধারায় ধুয়েমুছে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। আর প্রথম ঝর্ণা দেখে শেষ করার পর উপরের ঝর্ণাগুলোও দেখে আসার আকাঙ্খা আরো বেড়ে যেতে বাধ্য।
ট্রেইলের সবগুলো ঝর্ণাই অসম্ভব সুন্দর। সবগুলো ঝর্ণায় ১০/১৫ মিনিট করে সময় ব্যয় করলে পুরো ট্রেইল শেষ করতে তেমন ক্লান্তি লাগবে না আশা করি। যারা সাঁতার জানেন তাদের জন্য ১২ নাম্বার ধাপে রয়েছে আরেক রোমাঞ্চ! ঝর্ণার সামনে ছোটখাটো একটা পুকুর রয়েছে যেখানে আপনি সাঁতার কাটতে পারবেন মনের সুখে। খৈয়াছড়া ঝর্ণার বিবরণ আর বাড়ালাম না। এর বাকি রূপটা না হয় সারপ্রাইজ হিসেবেই থাকুক!
যেখানে খাবেন
যদি ফেনী হয়ে আসেন তাহলে সকালের নাশতাটা ফেনীতে সেরে আসলেই ভালো হবে। আর যদি বড়তাকিয়া নামেন তাহলে বড়তাকিয়া বাজারের যেকোন দোকান থেকে হালকা নাশতা করে নিতে পারেন। অথবা খৈয়াছড়া যাওয়ার পথে রেললাইন পড়ে এক জায়গায় যেখানে কিছু হোটেল রয়েছে। খৈয়াছড়া পাহাড়ি পথে অনেকগুলো হোটেল পড়ে। সেগুলোতে দুপুরের খাবার খেতে নিতে পারেন। ১০০ টাকার মধ্যেই সেখানে ভালো খাবার পাওয়া যাবে।
অন্যান্য
গাইড: খৈয়াছড়া ট্রেইলে যাওয়ার পথে অনেক ছোট ছেলে থাকে। ওরা গাইড হিসেবে আপনার সাথে যেতে চাইবে। ১০০/২০০ টাকা দিলেই ওরা পুরো ট্রেইল ঘুরে দেখাবে। আপনি চাইলে গাইড নাও নিতে পারেন। কিন্তু আমার মতে গাইড নেওয়া ভালো। কারণ গাইড থাকলে ওরা নামার সময় সহজ রাস্তা দিয়ে নামিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
ঝর্ণা থেকে ঢাকা ফেরার পথে বড়তাকিয়া থেকে লোকাল বাসে মিরসরাই আসতে পারেন। সেখান থেকে ঢাকা আসার ভালো বাস পাওয়া যায়। বিকালের মধ্যে ঝর্ণা ট্র্যাকিং শেষ করতে পারলে রাতেই আপনি ঢাকা ফিরে আসতে পারবেন।
সাবধানতা
খৈয়াছড়া ঝর্ণা খুব একটা সহজ ট্রেইল না। এখানে ছোট বড় অনেক ঝুঁকি রয়েছে। বেখেয়ালিভাবে ট্র্যাকিং করলে যেকোনো সময় বড় ধরনের বিপদ ঘটতে পারে। ঝিরিপথে পা ফালানোর সময় সাবধানে পা ফেলবেন। বৃষ্টির দিন পাহাড়ে উঠার পথ অনেক পিচ্ছিল থাকে। যেকারণে অনেক সাবধানে পা ফেলতে হয়। যাদের আগে কখনো ট্র্যাকিং করা হয় নি তাঁরা যাওয়ার পথে বাঁশ কিনে নিয়ে যেতে পারেন। তাহলে পাহাড়ে চলতে সুবিধা হবে। আর ট্রেইলে যদি জোঁক ধরে তাহলে ঘাবড়াবেন না। জোঁকের চোষকের দিকে লবণ ছিটিয়ে দিলেই জোঁক ছেড়ে দিবে।
সচেতনতা
আমাদের প্রকৃতির সৌন্দর্য্য রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। কোনো অপচনশীল দ্রব্য যেমনঃ চিপসের প্যাকেট, পলিথিন, পানির বোতল ইত্যাদি ট্রেইলে ফেলে আসবেন না। যদি সম্ভব হয় তাহলে এই ব্যাপারে অন্যকেও সচেতন করবেন।
শুভ হোক আপনার ভ্রমণ!