|| শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা থেকে ||
কাট ১
শিশু বেলায় সব কথা সঠিক ভাবে উচ্চারন করতে পারতনা ছোট্ট মেয়েটা। অনেক অক্ষর আদো আদো করে বলত। বাড়ির রান্নার ঠাকুরের কাছ থেকে খুন্তি কেড়ে নিয়ে সে বলত ‘তুমি সরে যাও,আমি আন্না করব!’
ইচ্ছামতী ও পদ্মার তীরে খেলে ঘুরে বেড়িয়ে নৌকো চড়ে কিশোরীটির দিন কাটত।পড়াশুনোয় মাঝারি ছিলেন কিন্তু নাচ গান আর গ্লাস পেন্টিং এর গুন ছিল তাঁর।
পাবনার মেয়ে কৃষ্ণা। আদি বাড়ি যশোর। বাবা করুনাময় দাশগুপ্ত কর্মসূত্রে চলে আসেন তাঁর পরিবার নিয়ে পাবনায়। মা ইন্দিরা দেবী। পাঁচ বোন ও চার ভাই কৃষ্ণার। কৃষ্ণা ছিলেন পঞ্চম।
কৃষ্ণা নামের সঙ্গে আজকের পাঠক হয়তো পরিচিত নন। কিন্তু তাঁর প্রথম নাম কৃষ্ণা। মামারবাড়ীতেও তাঁকে এই নামে সবাই ডাকত। যখন সে স্কুলে পঠণ-পাঠণ শুরু করল তখন কৃষ্ণার নাম দেওয়া হল রমা।
রমা রূপে গুনে সুন্দরী হয়ে উঠত লাগল। সে কোথাও গিয়ে দাঁড়ালে ছেলেদের চোখ চলে যেত তাঁর দিকে। রমা আরেকটু বড় হতে তাকে নিয়ে কলেজের ছেলেদের অবধি আগ্রহ বাড়ল।
এদের নজর থেকে বাঁচতে সুচিত্রা জননী ঘরের জানলা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিতেন। কিন্তু রমা এসবে ভীষন রেগে যেত। সুচিত্রা সেন তো কম ‘পুরুষ’ ছিলেননা। সেটা ঐ কিশোরি রমার ভিতর দেখা যেত।জানলা বন্ধ করার নির্দেশ মা দিলে রমা রেগে গিয়ে বলত, ‘অন্ধকার ঘরে থাকব নাকি … খোলো জানলা।’
ইস্কুলে যাবার সময় রমাদের ফুলপিসি বাণীপিসি ওদের স্কুলে নিয়ে যেতেন। ফুল পিসি আগে আগে হাঁটতেন পরে রমা উমা বোনরা। ছেলেদের টিপ্পনি তাতেও চলত। ছেলের দল বলত ‘ইঞ্জিন চলেছে, পিছনে বগি।’ এসবে ফুলপিসির কিছু এসে যেতনা বীরদর্পে হেঁটে যেতেন। ইনি ছিলেন আবার ‘পাবনা গার্লস হাইস্কুল’-র শিক্ষিকা। এই স্কুলের ছাত্রী ছিলেন কৃষ্ণা দাশগুপ্ত আমাদের মহানায়িকা সুচিত্রা সেন।

কাট ২
মা বাবা পিসি কাকা ভাই বোন আত্মীয়দের থেকে রমাকে বিছিন্ন করে দূরদ্বীপবাসিনী করে দেয় সুচিত্রা সেন। কৃষ্ণা রমার চেয়েও সুচিত্রা সেন বড় হয়ে ওঠে। সুচিত্রার এই গোপনীয়তা রহস্যময়তা শুধু সুচিত্রা জারি রাখেননি সেন পরিবার ও তাদের সমগ্র আত্মীয়রা যাপন বপন পালন করেন সুচিত্রার নির্দেশ।
‘আপনি যান সুচিত্রা সেনের বাড়ি?’
‘সুচিত্রা সেনকে দেখেছেন সামনে থেকে?’
‘কিভাবে অন্তরালে দিন কাটে সুচিত্রার?’
‘কেন ছাড়লেন সিনেমা?’
‘ফোনেও কথা বলেননা?’
‘বারণ এত বারন কেন?’
এইসব প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে রোজ যেতে হয় সুচিত্রা’র কাছের মানুষদের। যশোর পাটনা জামশেদপুর কটক কলকাতা ও শান্তিনিকেতনেও ছড়িয়ে থাকা বিরাট বৈদ্য সম্প্রদায় সুচিত্রা ব্রত পালন করেছে। যেন নায়িকার গোপনীয়তার অবগুন্ঠন উন্মোচন না হয়।
রমা যে আমাদেরও তাই তার কোনো কথাই বলা যাবেনা। রমার নির্দেশ। মিডিয়ার থেকে দূরে থেকেছেন তাঁরা। সুচিত্রা কিন্তু তাঁর সুপারস্টার তকমার জন্য দায়িত্ব অস্বীকার করেননি। বাবা-মা’র সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ রেখেছেন।
ছোট বোন রুনা দেবীর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন বিখ্যাত ইভেন্ট ম্যানেজার বারীন ধর মহাশয়ের। যিনি সুচিত্রার সবকাজের সারথীও। তিনিও বলতেন সুচিত্রা সেন সম্পর্কে ‘রাঙাদির বেশি কাছে যেওনা জ্বলে যাবে।’

বড়দি উমা সুচিত্রার চিরকালের বেশী আপন উমা দেবীর সঙ্গে রমার বেশী জমত। সুচিত্রা সেজ বোন হেনা দেবীর বাড়ি গিয়েও মিডিয়া নানা প্রশ্ন করে। হেনা দেবী বলেন ‘কিছু বলতে পারবনা রমা রাগ করবে।’ বোনঝিরাও রমা মাসী অন্ত প্রান।
পরিবারের লোকরাও বুঝিয়ে দেন আকার ইঙ্গিতে তাঁদের কৃষ্ণা রমা, রমাদি, রমামাসি, রাঙাদি, রাঙা মাসি, রমা দিদার সবচেয়ে নিকট জন হচ্ছেন সুচিত্রা সেন। যাকে নিয়ে এসব প্রশ্ন তাদের জীবনে বড় বিড়ম্বনা। কিন্তু এরকম লেজেন্ডের সান্নিধ্য যারা পেয়েছেন তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান ভাগ্যবতী।
তাঁদের সঙ্গে দেখা হওয়া মানেও সুচিত্রা সেনকে দেখা।
কাট ৩
সুচিত্রা সেনের শেষ জন্মদিনে সুচিত্রার ফ্ল্যাটের ঘরে তোলা ছবি। রমার বড় বোনঝি ডুনডুন (যার নাম মিলিয়ে মুনমুন), সুচিত্রার সেজ বোন হেনা দেবী এবং সুচিত্রা সেনের বড়দি, ডুনডুনদির মা উমা দেবী। তাঁদের পাশেই কিন্তু সেদিন সুচিত্রা সেন বসেছিলেন।

সেদিন সুচিত্রারা পাঁচ বোন এক হয়েছিলেন সুচিত্রার ফ্ল্যাটে। পুরী থেকে সেদিন উমা দেবী তাঁর রমার জন্য একটা গোলাপী চাদর আনেন, উপহার দেন। খুব খুশি হয় রমা। সবাইকে দারুণ খাওয়ালেন সুচিত্রা নিজে কিছু খাননি যদিও।
মুনদি রাইমাও রান্না করে আনে সেদিন। উমা দেবী খুব কাছের ছিলেন সুচিত্রা সেনের। বড়দি উমা দেবীকে ফোন করে বলতেন সুচিত্রা ‘কি এত কাজ তোমার দিদি, চলে এসো আমার বাড়ি।’ মারা যাবার ক’সপ্তাহ আগেও বড়দিকে বলছেন, ‘সর পুঁটি মাছ খাওয়াবে বড়দি?’ উমা দেবী সুচিত্রার ফ্ল্যাটেই রাঁধেন সর পুঁটি মাছ। দুই বোন একসঙ্গে বসে খান। এর কিছুদিন পরই সব মুছে যায়।
সুচিত্রা চলে গেছেন তবু তাঁর যাপনের কৌতুহল থেকে মুক্তি নেই আমাদের।