সময়টা ১৯৯৫ সাল, বাসা ভর্তি মেহমান। আমাদের দেশের প্রথা অনুযায়ী বিয়ের আগে মেয়েপক্ষ আর ছেলেপক্ষ পরষ্পরকে দেখতে আসবে। এই প্রোগ্রাম টা ছিল আমার মামার। পাত্রীপক্ষের সেই মানুষগুলোর মাঝে আমাদের বয়সী একটা মেয়েও ছিল, সে ছিল পাত্রীর বোনের মেয়ে। প্রতিটা মানুষের জীবনেই এমন একটা বয়স আসে যখন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি বাড়তি একটা আকর্ষণ জন্মায় (আতেল ব্যাতিত)। যেহেতু আমি আঁতেল নই তাই আমিও এর বাইরে ছিলাম না।
তবে আমি আমার সমসাময়িক বন্ধু বান্ধবদের মতো অতটা স্মার্ট না থাকায় নিজ থেকে মেয়েদের সাথে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করতাম। এর মাঝে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল যখন দেখলাম আমার বড় ভাইদের একটা গ্রুপও সেই মেয়েটার পেছনে ঘুরঘুর করছে। বড় ভাইরা ঘুরছে, কাজেই আমাদের গ্রুপের আশা শেষ। সুন্দরী মেয়েরা সচরাচর এই ধরণের প্রোগ্রামে আসলে তার পেছনে ছেলেদের ঘুরাঘুরি দেখলে খুশি হয়। এই মেয়েটা দেখলাম একটু ব্যতিক্রম।
ঘরের ভেতরে একটা সোফায় বসে একটা বই নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকলো। পুরো সময় জুড়ে মেয়েটা বই নিয়েই পড়ে রইলো। একটা সময় তাদের ফেরার সময় হলো। ভদ্রতাবশত আমরা বিদায় দেয়ার জন্য পাশে দাড়ালাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম বড় ভাইদের গ্রুপটাও দাঁড়িয়ে আছে। দুইজন বড় ভাই আবার ভাব নেয়ার জন্য এই রাতের বেলাতেও সানগ্লাস পড়ে আছে। আমার চোখে পাওয়ারের চশমা থাকায় সানগ্লাস পড়তে পারি নি।
– এক্সকিউজ মি। এই বইটা কি আপনার?
মেয়েটা হটাৎ করে আমাকে জিজ্ঞেস করলো। বইটা আমার ছিল না। এক বন্ধুর কাছ থেকে পড়ার জন্য নিয়ে এসেছিলাম। তবুও বললাম ‘জ্বি’।
– যদি কিছু মনে না করেন বইটা কি আমি নিতে পারি? আমি কখনো বই পড়িনি। আজ পড়া শুরু করে মনে হলো শেষ না করতে পারলে মরেই যাব।
একটা মানুষ মরে যাওয়ার চেয়ে বই ফেরত না দেয়া অপেক্ষাকৃত কম দোষের। তাই আমি না করতে পারলাম না।
– ঠিক আছে, কোন সমস্যা নেই।
– আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি এটা আবার ফেরত পাঠাব।
বেশির ভাগ মেয়েরা কথা দিয়ে কথা রাখে না, সেই মেয়েটিও রাখে নি। তবে এই প্রসঙ্গে মেয়েটার তেমন কোন দোষ ছিল না। প্রথম কারণ পরবর্তীতে আমার মামার সাথে মেয়েটির খালার বিয়ে হয় নি। কাজেই আর যোগাযোগ হয় নি। দ্বিতীয় কারণ বইটা ছিল হুমায়ূন আহমেদের। হুমায়ূন আহমেদের বই একবার শুরু করে শেষ না করে উঠতে পেরেছেন এমন পাঠক হয়ত কমই আছেন। হয়ত মেয়েটার বাসা থেকে আরেকজন পড়তে নিয়ে গিয়েছে।
‘হুমায়ূন আহমেদের বই শুরু করে শেষ না করে উঠতে পারি নি’ এমন অভিজ্ঞতার সাথে আমি ছাড়াও আরো অনেক পাঠক নিশ্চয়ই পরিচিত। তবে কোন এক বিচিত্র কারণে আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষ (এরা সাহিত্য বোদ্ধা নামে পরিচিত) হুমায়ূন কে পচাতে পারলে আনন্দিত হয়। এদের কথা শুনলে মনে হয় যে কেউ চাইলেই হুমায়ুন আহমেদ হতে পারবে।
হুমায়ূন আহমেদের লেখার সাথে আমার পরিচয় ১৯৯০ সালে। আমি ক্লাস ফোর এ পড়ি। ছোট বেলা থেকেই মোটামুটি বই পড়ার অভ্যাস ছিল। ঐ সময় প্রচুর কমিকস পড়তাম। বিশেষ করে চাচা চৌধুরী। বাবা বাসায় ‘দস্যু বনহুর’ পড়তো। সেটাও পড়া হতো। বন্ধুদের কাছ থেকে সেবা প্রকাশনীর বই পেতাম। হটাৎ একদিন আমার বন্ধু আমাকে একটা বই পড়তে দিল।
বইয়ের নাম ছিল ‘তোমাদের জন্য রুপকথা’। তখন লেখকের নাম জানতাম না। বইটি পড়ে খুব ভালো লেগেছিল। বইটি লিখেছিল হুমায়ুন আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদ কে আমি প্রথম চিনি ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটক দেখে। এর পর উনার অনেক বই পড়েছি। পড়তে পড়তে দেখি অনেক বই আগেই পড়া ছিল কিন্তু তখন উনার নাম জানতাম না। ইন্টারে পড়ার সময় ওনার সব বই পড়ে শেষ করে ফেললাম। জীবনে অনেক বই পড়েছি কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ এর বই পড়ে যত বার চোখ দিয়ে পানি পড়েছে তা আর কারো বইতে হয় নি। উনার প্রতিটি বই আমি অসংখ্য বার পড়েছি। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হয়েছে ছোটদের জন্য লেখা উনার মত বাংলাদেশে আর কেউ লিখতে পারেনি।
শুধু বই এর ক্ষেত্রে কেন বলছি? বাংলাদেশের নাটকে তিনি অসাধারণ পরিবর্তন এনেছেন। একটা সময় ঈদের নাটক মানেই হুমায়ুন আহমেদের নাটকের জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম। ‘এই সব দিন রাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’ – প্রতিটা নাটকই বাংলাদেশ টেলিভিশনে ইতিহাস গড়েছে। এই সব নাটক আমাদেরকে কাদিয়েছে, হাঁসিয়েছে – মোটকথা আমাদের শৈশব কৈশরের প্রতিটি মূহুর্ত ছিল হুমায়ূন ময়।
হুমায়ূন আহমেদ আসলে কোন ঘরনার লেখক? আশির দশকে রোমেনা আফাজ খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তার বই প্রকাশের সাথে সাথে শেষ হয়ে যেত। তার আগে জনপ্রিয় হিসেবে শিবরাম কিংবা শরৎচন্দ্রের নাম শোনা যায়। রোমেনা আফাজের বই এখন কয়জন পড়ে? অনেক পাঠক হয়ত নামই জানে না। শিবরাম এর নাম শুনলেও খুব কম পাঠকই তার সব কয়টি বই পড়েছে।
হুমায়ূন আহমেদ এর বই কি চল্লিশ বছর পর মানুষ আগ্রহ সহকারে পড়বে? সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ কিংবা তারাশঙ্কর এর ‘কবি’র মতো কালজয়ী কোন লেখা কি তিনি লিখতে পেরেছেন? ভক্তরা অনেক বইয়ের নাম বলবেন, বিরোধীরা ছ্যা ছ্যা করবেন। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, তারাশঙ্কর ‘কবি’ লেখার সময় নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন নি যে এটা কালজয়ী লেখা হবে। হুমায়ূন আহমেদের কোন লেখা আজ থেকে ৪০ বছর পর যে কালজয়ী হবে না তা কে বলতে পারে?
অনেক সময় আবার কোন লেখকের লেখা খুব বিখ্যাত হয়ে যায় কিন্তু লেখকের নাম অনেকেই জানে না। ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে সেই ছেলে হবে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ – এই কবিতাটি কোন বাঙ্গালী না শুনেছে? কিন্তু কুসুমকুমারী দাশ যে এই কবিতার রচয়িতা তা কয়জন জানে? আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর হুমায়ুন আহমেদের নাম কেউ মনে রাখবে কিনা তা সময়ের হাতেই ছেড়ে দিই।
তবে উনি মারা যাওয়ার পর দেশের প্রতিটা টিভি চ্যানেলে একযোগে উনাকে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার অনুষ্ঠানটা সরাসরি সম্প্রচার করেছে। উনাকে শ্রদ্ধা জানাতে যে লাখো মানুষের ঢল শহীদ মিনারে নেমেছিল, এই আবেগের বহিঃপ্রকাশ কিন্তু আমার এই জীবনে আর কারো জন্য দেখি নি, সামনে দেখব কিনা তাও জানিনা।
আমি অনেক সমালোচকদের মুখে শুনেছি যে যারা হুমায়ূন আহমেদ এর বই পড়ে তারা আর কারো বই পড়ে না। আমার মনে হয় কথাটায় একটু ভুল আছে। আমি মনে করি যারা কোন বই পড়ে না তারাও হুমায়ূন আহমেদ এর বই পড়ে। অনেকের কাছে উনি লেখক হিসেবে অনেক নিচু মানের এবং অনেকের মতে আজ থেকে ২০/৩০ বছর পড়ে উনার বই কেউ পড়বে না। হয়তো এই সব মানুষদের কথা ঠিক। তবে তাদের কথা ঠিক হলে আমি বলবো আমি খুব সৌভাগ্যবান যে আমি এ সময়ে জন্মেছি।
তাই ওনার বই পড়তে পেরেছি। একটা সময় নিউমার্কেটে ভারতীয় লেখকদের বই এর মাঝে বাংলাদেশের কোন লেখকদের বই খুঁজে পাওয়া যেত না। এই অবস্থাটার পরিবর্তন এনেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এই মুহুর্তে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের ঘরে যদি অন্তত ১০ টি বই ও থাকে তাহলেও তার মাঝে অন্তত একটা বই হুমায়ূন আহমেদের। বই মেলায় কোন স্টলের সামনে যদি অপ্রত্যাশিত ভিড় দেখা যেত তাহলেই বুঝা যেত যে সেই স্টলে হুমায়ূন আহমেদের নতুন বই প্রকাশ পেয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ বই মেলায় আসলে নাকি মেলার একদিক কাত হয়ে যেত। না হয়ে কি উপায় আছে? বেশীর ভাগ মানুষ যে তার দিকেই যেত!
তর্ক বিতর্ক চলবে, চলতে থাকুক। এত সহজে এটার কোন সমাধান আসবে না। তবে আমি খুশি এই ভেবেই যে হুমায়ূন আহমেদের সময়ে আমি বেচে ছিলাম, তাই সময়টা উপভোগ করতে পেরেছি।
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে আজকের এই দিনেই যে হুমায়ূন আহমেদ আমাদেরকে হাসিয়ে রাখতেন সেই তিনিই সবচেয়ে বড় দুঃখটা দিয়ে আমাদের থেকে বিদায় নিলেন। জাদুকর যেখানেই থাকুক সৃষ্টিকর্তা যেন তাঁকে ভালো রাখেন।