সাল ১৯৭১। মুক্তির নেশায় মাতাল পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনতার গর্জনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার নীল নকশা বাস্তবায়নে এদেশের নিরীহ মানুষের উপর এক বর্বর গণহত্যা চালায় পশ্চিম পাকিস্তানের বেনিয়া শাসকগোষ্ঠী। যুদ্ধ ক্রমেই ঘনীভূত হতে থাকে। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ওপার বাংলায় ভিটে মাটি থেকে উৎখাত হওয়া শরণার্থীর ঢল। এ ঢল সামলাতে এক পর্যায়ে হিমশিম খেতে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধী সরকার।
পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের এ বর্বরতা নাড়িয়ে দেয় বিশ্ববিবেককে। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশংকর আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেননি। বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে এবং শরণার্থীর এ বিশাল ঢলকে আর্থিক সহায়তা দিতে তিনি শরণাপন্ন হন বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের। দুজনে মিলে পরিকল্পনা করেন একটা কনসার্টের। ‘কনসার্ট ফর বাংলা দেশ’।
পরিকল্পনার আগে রবিশংকর জর্জকে পুরো যুদ্ধ পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিতে বিভিন্ন বিদেশী পত্রিকায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা পড়তে দেন। সেখানে নিরীহ মানুষের ওপর চালানো গণহত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতনের খবর পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠেন জর্জ হ্যারিসন। তিনি বলেন যে বাংলাদেশকে নিয়ে তিনি নিজেই গান লিখবেন, গাইবেন।
কনসার্টের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। বলে রাখা ভালো, তখন তাঁর ব্যান্ড বিটলসে বাজছে ভাঙনের সুর। কিন্তু জর্জ বাংলাদেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসার জন্য নিজের সব অভিমান বিসর্জন দিয়ে দলের বাকিদের সাথে যোগাযোগ করেন। শুধু পল ম্যাককার্টনি ছাড়া বাকি সবাই রাজি হন কনসার্টে গান করতে।
শেষে কনসার্টের লাইন আপ দাঁড়ায়, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, জর্জ হ্যারিসন, বিলি প্রিস্টন, লিয়ন রাসেল, ব্যাড ফিঙ্গার, রিঙ্গো রকস্টার, ওস্তাদ আল্লা রাক্ষা, সারোদ শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খান এবং পণ্ডিত রবিশংকর।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুরো প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে সময় ব্যয় হয়েছিলো মাত্র পাঁচ সপ্তাহ।
ভেন্যু হিসেবে বেছে নেয়া হয় নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার। তারিখ এক আগস্ট ১৯৭১। ঠি ৪৬ বছর আগের কথা।

১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে দুপুর থেকেই মানুষের ঢল নামতে শুরু করে ম্যাডিসন স্কয়ারে।
মূলত সেদিন দু’টি কনসার্ট হয়েছিলো – একবার বিকালে, আরেকবার সন্ধ্যায়। ৪টি গান ছাড়া সব গান দুই কনসার্টেই গাওয়া হয়েছিলো। দুইটি আলাদা অংশ ছিলো কনসার্টে।
প্রথম অংশ ছিলো ভারতীয় সঙ্গীতের উপর। এতে রবিশংকর আর ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ পরিবেশন করেন একটি বাংলা ধুন। বাংলাদেশি একটি লোকসঙ্গীতের উপর ভিত্তি করে তাঁরা এটি কম্পোজ করেন। দুইটি কনসার্টের শুরুতেই পরিবেশিত হয় এ কম্পোজিশন।
দ্বিতীয় অংশটি ছিলো সাধারণ পশ্চিমা ঢংয়ের কনসার্ট। গানগুলো হলো:
Wah-Wah
Something
That’s the Way God Planned It
It Don’t Come Easy
Beware of Darkness
While My Guitar Gently Weeps
Jumpin’ Jack Flash/Young Blood
Here Comes the Sun
A Hard Rain’s Gonna Fall
Blowing in the Mind
It Takes a Lot to Laugh, It Takes a Train to Cry
Just Like a Woman
My Sweet Lady

বিকালের কনসার্টে গাওয়া হয়েছিলো আরো তিনটি গান:
Awaiting on You All
Love Minus Zero/No Limit
Hear Me Lord
সন্ধ্যার কনসার্টে এর বাইরে গাওয়া হয় একটি গান:
Mr. Tambourine Man
কনসার্টের একেবারে শেষের দিকে উপস্থিত চল্লিশ হাজার দর্শকের সামনে জর্জ গেয়ে উঠেন
“NOW WON’T YOU LEND YOUR HAND AND UNDERSTAND?
RELIEVE THE PEOPLE OF BANGLADESH”
কনসার্ট থেকে অভাবনীয়ভাবে আড়াই লাখ মার্কিন ডলার উঠে আসে। যা পরে ইউনিসেফের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এর চেয়েও বড় ব্যাপার, পুরো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে যায় একটি নাম – বাংলাদেশ!