বহুকাল পরিব্রাজকদের তাড়া করা রহস্যময় ক্রোকার ল্যান্ড

আমরা এখন প্রযুক্তির যুগে বাস করি। আমরা এখন চাইলেই মোবাইল ফোন থেকে পৃথিবীর যেকোনো স্থানের মানচিত্র দেখতে পারি। যদিও আমাদের ভূপ্রকৃতি সময় সময়ে বদলে যায় এই স্থানগুলোর সাধারণ রূপরেখা প্রায়ই একই থাকে।

১৯৪৮ সালে উত্তর কানাডার প্রিন্স চার্লস এবং এয়ার ফোরস দ্বীপপুঞ্জের মানচিত্র বিমানের সাহায্যে তৈরি করা হয়। এটা ভাবতে অবাক লাগে এই বিশাল ভূমি এতদিন আবিষ্কার হয়নি। এই যে আমরা গোটা পৃথিবীর মানচিত্র তৈরি করে ফেললাম আমরা ভবিষ্যতে সেই রোমাঞ্চ থেকে বঞ্চিত হব যেটা আমাদের পূর্বপুরুষরা পেয়েছিলেন। সেটা হল নতুন স্থান আবিস্কারের রোমাঞ্চ।

শতাব্দীর পর শতাব্দী বিভিন্ন মানচিত্র তৈরি করা হত বিভিন্ন কাল্পনিক স্থানের ছবি দিয়ে। মেরু অঞ্চল ছিল ফাঁকা পরে যেটার মানচিত্র তৈরি করা হয় কারণ এই অঞ্চল মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য। মেরু অভিযানের কাহিনী মানবজাতির ইতিহাসে অন্যতম সুন্দর গল্প।

অনেক কাল্পনিক ভূমি যেগুলো আসলে মরীচিকা তা মানুষকে অনেকদিন ধরে বিভ্রান্ত করেছে। যেমন নিউ সাউথ গ্রিনল্যান্ড অথবা থমসন দ্বীপ যেটা আসলে বভেট দ্বীপের মরীচিকা। মরীচিকা একটি আলোকীয় ঘটনা। মরুভূমিতে প্রখর সূর্যতাপে ভূপৃষ্ট সংলগ্ন বায়ু উত্তপ্ত হয় এবং উপরের বায়ু অপেক্ষা হালকা হয়। আলো যখন কোন হালকা মাধ্যমে প্রবেশ করে এবং কোনো ব্যাক্তির চোখে পৌঁছানোর সময় এর পূর্ন আভ্যন্তরীণ প্রতিফলন ঘটায় তখন মনে হয় আলো কোন জলাশয় থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে। একেই মরীচিকা বলে। এটা নিম্ন মরীচিকা। আর ঊর্ধ্ব মরীচিকাও আছে। সেটা হয় শীতপ্রধান অঞ্চলে। কিছু কিছু মরীচিকাকে ফাটা মরগানা বলে।

ফাটা মরগানা একটি ঊর্ধ্ব মরীচিকা যা দিগন্ত উপরের সংকীর্ণ অঞ্চলের মধ্যে দেখা যায়। অস্বাভাবিক এবং জটিল রূপ এটির। সাগরের বুকে ফাটা মরগানা দেখে মনে হয় এগুলো সাগরের বুক থেকে উঠে এসেছে। যেমন দ্বীপ, মালভূমি বা পাহাড়। ফাটা মরগানা মেরু অঞ্চলে বেশি হয়। শত মাইল দূরের জিনিসও দেখা যায় এবং মনে হয় তারা কাছকাছি রয়েছে।

নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ হল এমন একটি সমুদ্রপথ যা উত্তর আমেরিকাতে প্রশান্ত এবং অ্যাটলান্টিক মহাসাগরকে সংযুক্ত করেছে।

স্যার জন রস ছিলেন একজন স্কটিশ রিয়াল অ্যাডমিরাল এবং মেরু অভিযাত্রী।

১৮১৮ সালে স্যার জন রস নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ আবিষ্কারে বের হলেন। তাঁর জাহাজ কানাডার ল্যানকাস্টার উপকূলে পৌঁছায়। সেখান থেকে নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ ঠিক সামনে গেলেই পাওয়া যায়। কিন্তু স্যার জন রস সেখান দিয়ে গেলেন না। কারণ তাঁর সামনে তিনি দেখতে পান একটি পর্বতমালা। তাঁর মনে হল এই দিক দিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তিনি এই পর্বতমালার নাম দিলেন ক্রোকার পর্বতমালা।

তাঁর ফার্স্ট মেট উইলিয়াম এডওয়ার্ড প্যারী এবং এডওয়ার্ড স্যাবাইনের প্রতিবাদ সত্ত্বেও তিনি সেখান থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে এলেন। এর এক বছর পর উইলিয়াম এডওয়ার্ড প্যারী এই অলিক পর্বতমালা ভেদ করে আরও পশ্চিমে যাত্রা করেন। এতে স্যার জন রসের সুনাম নষ্ট হয়ে যায়।

স্যার জন রসের দুটি ভুল হয়।

প্রথমত তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে এই পর্বতমালার অস্তিত্ব বাস্তবেই রয়েছে। যদিও তাঁর ফার্স্ট মেট উইলিয়াম এডওয়ার্ড প্যারী এবং এডওয়ার্ড স্যাবাইনের এর প্রতিবাদ করেন কারণ তারা এই ধরণের মরীচিকার সাথে পরিচিত ছিলেন। এটা আসলে একটা ফাটা মরগানা।

তাঁর দ্বিতীয় ভুল হল এই কাল্পনিক পর্বতমালার নামকরণ তিনি করেন ব্রিটিশ প্রশাসনের ফার্স্ট সেক্রেটারির নামে। এর ফলাফল খারাপ হয়। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে আর জাহাজ বা আর্থিক সাহায্য প্রদান করেনি। নিজের ব্যক্তিগত খরচে তাঁকে এরপর অভিযান পরিচালনা করতে হয়।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে অভিযাত্রীরদের মধ্যে একটি বিষয় নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কে সবার আগে উত্তর মেরুতে নিজের পদচিহ্ন একে দিবেন। এর ফলে একটি সুবিধা হল। এই অঞ্চল সম্পর্কে আরও নিত্য নতুন তথ্য জানা গেল। উপকূল অঞ্চলের মানচিত্র আরও পরিষ্কার হয়ে এল।

আমেরিকার এক বিখ্যাত পরিব্রাজক ছিলেন রবার্ট পিয়েরি। হ্যাঁ আমি সেই রবার্ট পিয়েরির কথা বলছি যিনি দাবী করেন তিনি ১৯০৯ সালের ৬ এপ্রিল সর্বপ্রথম উত্তরমেরুতে পা রাখেন। যদিও তাঁর দাবীও বিতর্কিত। কারন তাঁর যাত্রাপথের প্রাথমিক পর্যায়ে ৫ জন সহযাত্রী থাকলেও চুড়ান্ত পর্যায়ে তাঁর সাথে কেউ ছিলনা এবং তিনি যে রুট, সময় ও গতিতে উত্তরমেরু পৌঁছার কথা বলেন তা তার প্রাথমিক সহযাত্রীর বক্তব্যের সাথে মেলেনা। এভাবে ১৯৮৯ পর্যন্ত রবার্ট পিয়েরিকেই সর্বপ্রথম উত্তরমেরু জয়ী ধরা হয়।

কিন্তু, ওই সালেই ব্রিটিশ অভিযাত্রী ওয়ালি হার্বার্ট চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ঘোষণা করেন যে পিয়েরি আর তার দলবল আসলে ভুল তথ্য দিয়েছেন এবং তারা প্রকৃতপক্ষে উত্তরমেরু পৌঁছাননি। এরপর ২০০৫ সালে পিয়েরিকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসেন এবার আরেক ব্রিটিশ অভিযাত্রী টম এভারি। তিনি পিয়েরির বর্ণনা অনুযায়ী রুটে কুকুরবাহী স্লেজে চড়ে যাত্রা শুরু করেন এবং ৩৬দিন ২২ ঘন্টা পর তিনি উত্তর মেরু পৌছান। এই সময় পিয়েরির বর্ণনাকৃত সময় অপেক্ষা ৫ ঘন্টা কম। কাজেই এভারি ঘোষণা করেন যে রবার্ট পিয়েরি আধুনিক দিক-নির্দেশনা যন্ত্র ছাড়াই প্রকৃত উত্তরমেরুতে না পৌছাতে পারলেও এর সবচে কাছাকাছি গিয়েছিলেন এবং তিনিই প্রথম উত্তর মেরু জয়ী।

১৯০৫-০৬ সালে পিয়েরি এক্সেল হেইবারগ দ্বীপের কেপ থমাসে ক্যাম্প করার সময় তিনি দূরে একটি ভূখণ্ড দেখলেন যা তাঁর মতে ২০০ কিমি দূরে অবস্থিত। তিনি এই জায়গার নাম দেন ক্রোকার ল্যান্ড। জর্জ ক্রোকার ছিলেন রেলওয়ে মুঘল চার্লস ক্রোকারের ছেলে যিনি তার এই অভিযাত্রার খরচ বহন করেছিলেন। কিন্তু এই জায়গাটির প্রকৃত অবস্থান তিনি শনাক্ত করতে পারেন নি। অনেকে বলেন এটা ফাটা মরগানা আবার অনেকের মতে তিনি এই কাজটি করেন আরও স্পন্সর পেতে।

যাই হোক কয়েক বছরের ভিতর ক্রোকার ল্যান্ড মানচিত্রে স্থান পেল।

১৯১৩ সালে আরেক অভিযাত্রী ডোলানড ম্যাকমিলান ক্রোকার ল্যান্ডে পৌঁছাতে অভিযান শুরু করলেন। এই অভিযানের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় ইনুইটদের জীবন যাত্রা নিয়ে গবেষণা করে তা বিশ্বের কাছে তুলে ধরা।

ক্রোকার ল্যান্ড অভিযানের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য সফল হল। পশ্চিমারা ইনুইটদের জীবনধারা সম্বন্ধে জানতে পারল। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ভয়ানকভাবে ব্যর্থ হল। ক্রোকার ল্যান্ডের খোঁজ পাওয়া গেল না।

একপর্যায়ে ম্যাকমিলান ভাবতে শুরু করলেন তিনি ক্রোকার ল্যান্ডের খোঁজ পেয়েছেন। দিগন্তের সাথে ১২০ ডিগ্রি কোণে তুষারশুভ্র চূড়া দেখলেন। তাঁর এক ইনুইট ক্রুয়ের আপত্তির পরও তিনি তাঁর দলের এক ইঞ্জিনিয়ার ফিটযহাজ গ্রীনের কথায় সেদিকে জাহাজ চালাতে নির্দেশ দিলেন। হঠাৎ সেইছবিটি অদৃশ্য হয়ে গেল। এথেকে বোঝা গেল ক্রোকার ল্যান্ডের কোন অস্তিত্ব নেই।

এই অভিযান পরে আরও ট্র্যাজেডির সম্মুখীন হয়। ম্যাকমিলান সেই ইনুইট ক্রু পিউগাটক আর গ্রিনকে পশ্চিমে একটি পথ খুঁজতে পাঠান। সেখানে তারা বাদবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন এবং গ্রিন পিউগাটককে গুলি করে হত্যা করেন। ম্যাকমিলান ঘটনাটি ধামাচাপা দেন। এরপর আবহাওয়া তাঁদের প্রতিকূলে চলে যায় এবং তাঁরা বহুদিন সেখানে আটকে থাকেন।

১৯১৭ সালে নেপচুন নামে একটি জাহাজ তাঁদের উদ্ধার করেন।

অভিযান যদিও ব্যর্থ হল (কারণ ক্রোকার ল্যান্ডের মানচিত্র তাঁরা বানাতে পারেন নাই) তারা অনেক ফটোগ্রাফ এবং ইনুইটদের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের নমুনা সংগ্রহ করলেন। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যাদুঘরে তা প্রদর্শন করা হল।

এরপরেও ক্রোকার ল্যান্ড নিয়ে সন্দেহ থেকেই গেল। ১৯৩৭-৩৮ এর দিকে ম্যাকগ্রেগর আরটিক এক্সপিডিসনের সময় এই এলাকা বিমান দিয়ে প্রদক্ষিণ করে বোঝা গেল ক্রোকার ল্যান্ড বলতে আসলে কিছু নেই!

সর্বশেষ