প্রযুক্তি ও গবেষনার অগ্রগতির কারণে আমরা প্রাচীনকালের প্রায় অনেকটাই জানতে সক্ষম হয়েছি। এমনকি অনেকে এটাও দাবী করেন যে, তারা প্রাচীন সম্পর্কে সবটাই জেনে গেছে। তবুও, আমরা যতই অতীতের মানুষদের জীবন-যাপন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি না কেন, কিছু কিছু বিষয় আমাদের বিস্ময়ের কারণ হতে বাধ্য। কারণ, কিছু প্রাচীন কৌশল বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ বিস্ময়কর ছিলো বটে।
আজ তেমন-ই ১০ টি প্রাচীন পন্থা সংগ্রহ করে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি, যা দেখে অবশ্যই বিস্ময়ে আপনার চোখ কপালে উঠতে বাধ্য।
মেয়েদের চুল রঙ করতে লেড ও সালফারের ব্যবহার
মানুষ তাদের চুল অতিপ্রাচীন কাল থেকেই রঙ করে আসছে, কিন্তু রসায়নবিদ্যায় জ্ঞানের ঘাটতি থাকায় তারা কিছু ভুল উপাদান ব্যবহার করতো। যা পরবর্তীতে তাদের স্বাস্থ্যে নানান রকম সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রাচীনরা তাদের চুল রঞ্জিত করার জন্য উদ্ভিদ সামগ্রীও ব্যবহার করেছিল, কিন্তু তার প্রভাব দীর্ঘ হয়নি। গ্রীক এবং রোমানরা একটি স্থায়ী চুলের রং ব্যবহার করেছিলো যা সালফারসহ বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত।
১৭০০ শতাব্দির দিকে ইতালীয়রা তাদের লম্বা চুল সোনালী রঙে রাঙাতে পছন্দ করেছিলো। অনেক ইউরোপীয় মহিলা চেহারায় বিশেষ সৌন্দর্য্য অর্জন করতে শেফরণ এবং সালফার পাউডার ব্যবহার করতো। আফগানরা বিশ্বাস করতো চুলে আলাদা করে রঙ করলে তা মাথাব্যথা নিরাময়ে সাহায্য করে।
স্তন প্রতিস্থাপনে স্থল রাবার ও কাচ বলের ব্যবহার
প্রাচীন কাল থেকেই নারীরা তাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করেছেন। স্তনও এর ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। কেউ কেউ তাদের ত্বকের জন্য গ্রীষ্মকালীয় চিকিৎসা বা গৃহজাত কিছু ক্রিম ব্যবহার করতো । অনেকেই স্তন বৃদ্ধি করতে নারকেল তেলের মালিশ গ্রহণ করতো।
পৃথিবীর সর্বপ্রথম স্তন সার্জারি ১৮৯৫ সালে হয়। সেটা করেছিলেন ভিন্সেনজ জের্নি। এরপর ডাক্তাররা নানানভাবে নানা উপকরণ ব্যবহার করে স্তন বৃদ্ধি করতে। যার মধ্যে, আইভরি, কাচ বল, স্থল রাবার বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত।
চিকিৎসাক্ষেত্রে পশুর মল ও উচ্ছিষ্টাংশ ব্যবহার
শুনতে খুব অবাক লাগলেও বিষয়টা সত্য। প্রাচীনেরা বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে এবং চিকিৎসা কাজে পশু শোষণ প্রক্রিয়া ব্যবহার করতো। প্রাচীন গ্রীসের নারীরা বিশ্বাস করতেন, কুমিরের ছাই একটি শক্তিশালী গর্ভনিরোধক হিসেবে কাজ করে এবং তাই তারা তাদের যোনিতে এটি প্রবেশ করাতেন। প্রাচীন মিশরের যোদ্ধারা তাদের জখম ঠিক করতে পশু ব্যবহার করতো। ভুলেও, কিন্তু বাড়িতে এসব চেষ্টা করবেন না।
অশুভ চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে ডাক্তাররা মাথায় ছিদ্র করে দিতেন
মানুষটিকে মোটেই ভালো দেখাচ্ছে না, তাই না? ডাক্তাররা সবসময়ই মানব্দেহ নিয়ে কৌতুহলী ছিলেন। এই কৌতুহল থেকেই তারা অনেক রোগ নিরাময়ের কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন বটে। ট্রেপ্যানেশন (ড্রিলিং গর্ত) তাদের মধ্যে একটি ছিল। ডাক্তাররা বিশ্বাস করেন যে তারা রোগাক্রান্ততা, মাথাব্যথা এবং সংক্রমণের মতো রোগের প্রতিকার করতে পারে। তারা ভেবেছিলেন যে বিভিন্ন রোগ একটি মানুষের আত্মা ভিতরে তৈরি হয়, একটি মন্দ আত্মা দ্বারা সৃষ্ট হয়, এবং তাই তারা আত্মা বের করে দেওয়া যায় এমন একটি গর্ত করেন মাথায়। সৌভাগ্যক্রমে এই পদ্ধতি মধ্যযুগের দিকে পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
শেষকৃত্যে নারীদের কাঁদতে অনুমতি দেওয়া হয়নি
প্রাচীন রোমে মৃত্যুর মিছিলে রাস্তায় নেমে যেতেন মৃতের আত্মীয়-স্বজনেরা। শেষযাত্রায় একজন লোক ছিলেন, যিনি একটু বেশিই সম্মানী ছিলেন। কখনও পরিবারের সদস্যরা বেশিষ মহিলাদের নিয়োগ দিতেন যারা শবযাত্রাকে শোকাহত করে তুলতে বেশি করে কাঁদবে। তাদের বিষণ্ণতা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে গালে রক্তের দাগ লাগিয়ে দেয়া হতো এবং চুল ছিড়ে দেয়া হতো।
পরবর্তীতে এই ঐতিহ্য চরম নেতিবাচক বিবেচনা করা হয়। শবযাত্রায় মানুষকে বিরতিহীন কাঁদাতে পেশাদারকদের ভাড়া করার অনুমতি দেয়া হয় নি কারণ, এগুলো দৃঢ় আবেগ প্রয়োগ করেছিল এবং অনেকক্ষেত্রেই বিরূপ প্রভাব ফেলছিল।
যেকোনো পিতাই তার মেয়ের প্রেমিককে হত্যা করতে পারতো
তৎকালীন সময়ে পিতা সমগ্র পরিবার এবং বিশেষ করে তাদের অবিবাহিত মেয়েদের উপর খুব শক্তিশালো প্রভাব ছিলো। পিতাদের অধিকার ছিলো মেয়ের জন্য ভালো স্বামী খুঁজে দেয়ার। সমাজব্যবস্থা খুব কঠোর ছিল, কোনো মেয়ের বিবাহের আগে কোনো পুরুষের সাথে ঘনিষ্ঠ হবার অধিকার ছিল না।
একজন পিতা যদি চাইতেন তবে তিনি তার মেয়ে ও মেয়ের প্রেমিককে নির্দ্বিধায় হত্যা করতে পারতেন। যদি তিনি শুধুমাত্র প্রমিককে খুন করেন তবে তার উপর খুনের অভিযোগ হতে পারে। একটী অদ্ভুত সত্য, রোমান মহিলারা সবময়ই বাবার পরিবারের সদস্য হয়েই থাকতেন এমনকি বিবাহের পরেও।
প্রাচীন রোমে পিতা তাদের সন্তানকে দাস রূপে বিক্রয় করতে পারতেন, কিন্তু মাত্র ৩ বার
হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। প্রাচীন রোমে পিতা পরিবারের প্রধান ছিলেন এবং স্ত্রী-সন্তানের উপর তার পূর্ণ ক্ষমতা ছিলো। পরিবারে নতুন সন্তান রাখার সিদ্ধান্ত পিতাই গ্রহণ করতেন। একজন পিতাকে তার সন্তান দাস হিসেবে বিক্রয় করার অধিকার দেয়া হয়েছিলো।
যদি কোনো ব্যাক্তি সেই সন্তানকে ‘ক্রিতদাস’ হিসেবে ক্রয় করার পর মনে করতেন, তার দাসের কোনো প্রয়োজন নেই, তবে সন্তানটিকে আবার বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে যাওয়া হতো। পিতা এরকমভাবে ৩বার একটি সন্তানকে বিক্রয় করার অধিকার রাখতেন। সেক্ষেত্রে তাকে একজন খারাপ পিতা হিসেবে গণ্য করা হতো। সৌভাগ্যবশত, এরকম খারাপ পিতা মাত্র কয়েকজন ছিলেন।
গর্ভধারণ বুঝতে রসুনের ব্যবহার
চিকিতসাশাস্ত্রে জ্ঞানের অভাবে প্রাচীন ডাক্তাররা বুঝতেন না, ঠিক কেন কিছু নারী গরভবতী হচ্ছেন এবং বাকিরা হতে পারছেন না। তবে, গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করতে তারা বেশ কিছু প্রাকৃতিক পন্থা ব্যবহার করতো। ১৩৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে, একটি গম বীজ মূত্রের সাথে সিক্ত করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল একজন মহিলাকে।
যদি বীজটি অঙ্কুরিত হয় তবে মহিলা গর্ভবতী ছিলো যদি না হয় তবে ছিল না। গর্ভাবস্থার আরেকটি পন্থা ছিল। যা হলো, যোনীতে রসুন, পেয়াজ বা একটি লবঙ্গ স্থাপন করে পরের সকালে যদি নারী শ্বাস প্রশ্বাসে গন্ধ পাওয়া যেত তবে তাকে গর্ভবতী বলে দাবী করা হতো।
প্রাচীন মিশরের মানুষ তাদের বিড়ালদের প্রতি শোক প্রকাশে তাদের চোখের ভ্রু কেঁটে ফেলতো
প্রাচীন মিশরের বাসিন্দারা তাদের প্রিয় প্রাণী হিসেবে বিড়ালকে পূজা করতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে বিড়াল তাদের পরিবারে সুখ বয়ে আনতে পারে। তাদের বাড়িতে বিড়াল এবং উর্বরতার দেবী বাস করতো। বিড়ালদের তারা পবিত্র বলে বিশ্বাস করতো, যারা এদের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিলো তাদের পরবর্তীতে শাস্তি পেতে হয়েছিল।
মিশরের একটি পরিবার তাদের ভ্রু কাঁটা বন্ধ করে দিয়েছিল, যার দরুন তাদের পরিবারের বিড়ালটি মারা যায়। পরবর্তীতে সেই বিড়ালটিকে একটি কাঠের ভাষ্কর্য করা মুখোশ সাথে একটি ছোট মমি বানিয়ে পারিবারিক সমাধীস্থলে দাফন করা হয়।
মজার বিষয়, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, জুলিয়াস সিজার, চেঙ্গিস খান, নেপোলিয়া, হিটলার অলিউরোফোবিয়া বা বিড়ালভীতি রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
প্রাচীন রোমে গণ–শৌচাগার নির্মিত ছিল
আমরা ইতিমধ্যে জানি যে প্রাচীন রোমের লোকেরা তাদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি যত্ন নেওয়ার জন্য সমস্ত সম্ভাব্য উপায় ব্যবহার করেছেন। তারা নিয়মিত গণ-গোসলখানা এবং টয়লেট ব্যবহার করতেন। যাইহোক, শুধুমাত্র কয়েকজন ধনী ব্যাক্তি ব্যতিত কেউ ব্যক্তিগত গোসলখানা-টয়লেট নির্মাণ করার সামর্থ্য তাদের ছিল না।
অন্যান্য ৯৫% মানুষের জন্য ব্যবহৃত পাথর বা কাঠের লম্বা সারি করে শৌচাগার তৈরি করা হয়েছিল। ফ্ল্যাশের দ্বারা বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। রোমান সভ্যতাকে সকল সভ্যতা থেকে উচ্চ পর্যায়ে রাখার জন্যই এ প্রচেষ্টা করেন রোমান সরকার।
যুগে যুগে মানুষ অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। এখন আর মানুষ প্রাচীন কালের মানুষদের মত চিন্তা করে না। চিন্তাধারাও বদলে গেছে আমাদের। কতটা বদলেছে, তারই প্রমান যেন এই ভুতুড়ে ১০ টি রীতি।
– গিগগ্যাগ.কম অবলম্বনে